বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতারের গোপন কেন্দ্র থেকে ২৮ এপ্রিল এক বেতারবার্তায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানান। পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য নিঃশর্তভাবে অর্থ ও অস্ত্র দিতেও তিনি আবেদন জানান।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এদিন ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ দেখা করেন। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নিপীড়ন সম্পর্কে বিশ্বজনমত গঠনের ব্যাপারে কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে জানান, তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শিগগির জাতিসংঘে যাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে জনমত সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক শান্তিকামীদের একটি দল লন্ডন থেকে পদযাত্রা করবে এবং বিভিন্ন দেশের এমপিদের একটি প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশের অবস্থা সরেজমিন জানানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গান্ধী ফাউন্ডেশনের সম্পাদক রাধাকৃষ্ণ বলেন, ভারতের গান্ধীবাদী সংগঠনগুলো বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিদল পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে। তিনি বলেন, ভারতীয় শান্তিকামী সংগঠনগুলোর উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি অভিযান শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে যুদ্ধ প্রতিরোধকারী লিগ, আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি, আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ এবং শান্তি কনফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের পক্ষে

ব্রিটেনের কমন্স সভার লেবার পার্টির সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান ভারতের বিভিন্ন শরণার্থীশিবির পরিদর্শন শেষে নিজ দেশে ফিরে যান। সেখানে তিনি বলেন, পাকিস্তানি শাসকেরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। নারী-শিশু-বৃদ্ধ—কেউ রেহাই পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা সম্পর্কে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই।’

ডগলাসম্যান জানান, তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাত দফা সুপারিশ দেবেন। সুপারিশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং পাকিস্তানকে অর্থসাহায্য বন্ধ রাখার বিষয় থাকবে।

বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে এদিন বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশের রক্তগঙ্গা বন্ধ করার জন্য বিশ্ব জনমত ও বিশ্বের সর্বত্র শান্তিকামী শক্তিগুলোকে অবিলম্বে তৎপর হতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতা ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষা করতেই হবে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতা।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে চিঠি পাঠান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের সাহায্যকারী সংস্থাগুলো ভারতে যা পাঠিয়ে থাকে, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেসব দেওয়ার জন্য অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ভারতের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর প্রশাসনিক প্রধানদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানোর ব্যাপারে কথা বলেন। তবে কী ধরনের সাহায্য পাঠানো হবে, তা বলেননি। বিশ্ব খাদ্য কার্যক্রম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা সাহায্য পাঠাবে বলে জানা যায়।

ভারতের মুসলমান নেতারা বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার নিন্দা জানান। দিল্লিতে জুলফিকার আলী খান এমপি মুসলিম দেশ, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর নেতাদের বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার আবেদন জানান। পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুসলমান নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সাহায্যের আবেদন জানান।

কলকাতায় বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির পক্ষে সভাপতি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক মণীন্দ্র রায়, নীরেন্দ্রনাথ রায় এবং দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত আসা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটির সম্পাদক বীণা ভৌমিক জানান, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে একটি মহিলা বিভাগ খোলা হয়েছে।

২৬ এপ্রিল থেকে সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পাকিস্তানি সেনা আক্রমণের চারটি ঘটনায় ৩৩ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত, অন্তত ৮ জন আহত এবং ২ জন নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারত। পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে তিনটি নোট পাঠানো হয়।

পাকিস্তানি সেনারা এই দিনে যশোরের বয়রার কাছে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মালিদা গ্রামে ঢুকে গুলি ছোড়ে। বিএসএফ পাল্টা গুলি ছুড়লে তারা পালিয়ে আসে।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

২৭ এপ্রিল থেকে সান্ধ্য আইনের মেয়াদ রাত সাড়ে ১০টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার মিরপুরে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালায়। সেনাদের সঙ্গে স্থানীয় অবাঙালিরা অংশ নেয়। বহু বাঙালিকে সেনারা ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের বেশির ভাগই আর ফিরে আসেননি।

পাকিস্তানি সেনারা মাধবপুরে তীব্র হামলা করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান ছেড়ে সিলেটের মনতলায় চলে যান। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষতি হয়। খালেদ ও শাহজাহান নামের দুজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বাদশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর তিন; দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ এপ্রিল ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৯ ও ৩০ এপ্রিল ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান