বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই দিনে দেশবাসীর উদ্দেশে ১৮ দফা নির্দেশনামা জারি করেন। তিনি সরকারের নির্দেশ মেনে কাজ করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
নির্দেশনার মধ্যে ছিল শত্রুকবলিত এলাকায় বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করা, কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেওয়া, নৌ চলাচলসহ সব যোগাযোগে শত্রুকে অসহযোগিতা করা, গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলা, শত্রুপক্ষের গতিবিধির খবর মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দেওয়া, মুক্তিবাহিনী ছাড়া কারও কাছে জ্বালানি বিক্রি না করা, শত্রুবাহিনীর বা আত্মসমর্পণকারী সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা ইত্যাদি।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিন করাচিতে এক সভায় সংকট নিরসনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে আহ্বান জানান।
টাইম ম্যাগাজিন-এর এদিনের প্রচ্ছদকাহিনি ছিল ‘দ্য ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’ শিরোনামে কুষ্টিয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বে কুষ্টিয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জয় ছিল লেখাটির বিষয়বস্তু। লিখেছিলেন ড্যান কগিন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী ও মালিক মোহাম্মদ কাশেম এদিন গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
এদিন ঢাকা নগরীর বিভিন্ন মহল্লার শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ অফিসারদের নাম ঘোষণা করা হয়।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের বাঙালি সেনা, পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-যুবকের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাবনার সাঁথিয়ায় পাইকরহাটি গ্রামের ডাববাগানে (বর্তমানে শহীদনগর) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী একটি দলকে প্রতিরোধ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনাদের এই দলটি ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের
আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা সম্মুখযুদ্ধে টিকতে না পেরে পিছু হটে নগরবাড়ী ফিরে যায়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শহীদ হন ইপিআর হাবিলদার ইমদাদ উদ্দিন, নায়েক মফিজউদ্দিন, ল্যান্স নায়েক আতিয়ার রহমান, সালেহ আহমদ, সেপাই নূর উদ্দিনসহ নাম না জানা আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। নেতৃত্ব দেন ইপিআরের সুবেদার গাজী আলী আকবর।
ডাববাগান থেকে পিছু হটে যাওয়া পাকিস্তানি বাহিনী শক্তি বাড়িয়ে রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাল্টা আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড শক্তির কাছে টিকতে না পেরে মুক্তিসেনারা পিছু হটে যান। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে শতাধিক নিরীহ মানুষকে। গ্রামবাসীর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। একে একে পুড়িয়ে দেয় ডাববাগানের পাশের রামভদ্রবাটি, কোড়িয়াল, বড়গ্রাম, সাটিয়াকোলা গ্রাম।
সিলেটের সালুটিকর বিমানঘাঁটির দখল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর দিনভর ব্যাপক যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে বিমান হামলা করলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
কুষ্টিয়ার দর্শনায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি লড়াই হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ভারতে চলে যান। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী দর্শনায় ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি গণহত্যা চালায়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, তিন, সাত ও আট; বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, ফজলুল কাদের কাদেরী; দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ এপ্রিল ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান