বিজ্ঞাপন
default-image

ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি ১ অক্টোবর দিল্লিতে বলেন, ভারতের সঙ্গে বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশ প্রশ্নের ফয়সালায় তাঁর দেশ সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য করবে। ভারত উপমহাদেশের বিপজ্জনক ও কঠিন পরিস্থিতির দিকে সোভিয়েত জনগণ বিশেষভাবে নজর রেখেছেন। তাঁর সম্মানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির দেওয়া ভোজসভায় তিনি এ কথা বলেন। ভারত উপমহাদেশের জনগণের আইনসংগত অধিকার ও স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে একটি যুক্তিযুক্ত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সম্ভাব্য সব রকম সহযোগিতার প্রস্তাবও তিনি দেন।

ভোজসভায় ভি ভি গিরি বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আরও শরণার্থী আগমন বন্ধ করা একান্ত দরকার। পূর্ব বাংলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বকে পাশ কাটিয়ে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হলে তাতে শুধু পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটেই করা হবে।

নিকোলাই পদগোর্নি হ্যানয় যাওয়ার পথে এক দিনের সফরে দিল্লি এলে তাঁকে এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের কে এম শেহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মিশনের কর্মী ও সমর্থকেরাও বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।

দিল্লিতে একটি কূটনৈতিক সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য চেষ্টা করছে। তবে দিল্লির কূটনৈতিক মহল মোটামুটি এই মত পোষণ করে যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দিয়ে কাজ হবে না।

দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের আবদুশ শহীদ নামে আরেকজন বাঙালি কর্মী এ দিন হাইকমিশনের
দেয়াল টপকে পালিয়ে বাংলাদেশ মিশনে এসে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ প্রশ্নের মীমাংসায় তিন শর্ত

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কে বলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি এবং ইয়াহিয়ার দখলদার বাহিনীর অপসারণ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক সমাধানই বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। জাতিসংঘের চার্চ সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

আবু সাঈদ চৌধুরী আরও বলেন, এই তিনটি শর্ত নিয়ে কোনো আলোচনা চলতে পারে না। এই শর্তগুলোতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন কি না সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো আশা নেই। তবে বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কে বলা যায় যে এই তিন শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সমাধানই হবে না।

মুক্তিবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের একদল নৌ কমান্ডো এই দিন চট্টগ্রাম বন্দরে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি গ্রিক ট্যাংকার ডুবিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে নৌ গেরিলাদের জোর তৎপরতায় বিদেশি জাহাজের নাবিকেরা চট্টগ্রাম বন্দর ও খুলনার চালনা বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। ২১ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর নৌ গেরিলারা একটি পাকিস্তানি জাহাজের বেশ ক্ষতি করে। ঢাকাতেও পাকিস্তানি সেনারা দল না বেঁধে বাইরে যেতে পারছে না।

যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স নিউইয়র্কে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের ক্রমাবনতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হোমের সঙ্গে বৈঠক করেন। ভারতে ব্যাপক হারে বাংলাদেশি শরণার্থী আসার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা দুজনই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদা এ দিন ভারতে আসা শরণার্থী ও বাংলাদেশের দুঃসহ পরিস্থিতি নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। এ ছাড়া সোভিয়েত শান্তি কমিটির গতকালের বিবৃতি এবং সোভিয়েত ট্রেড ইউনিয়ন ও কারখানার শ্রমিকদের একটি বিবৃতিও প্রাভদা প্রকাশ করে। বিবৃতিতে তারা পূর্ব বাংলার জনগণ এবং তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানায়। মস্কোর কূটনৈতিক মহল জানায়, এ থেকে স্পষ্ট যে সোভিয়েত সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে গণমাধ্যমে পালিত সতর্কতা থেকে তারা সরে এসেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর এ দিন মস্কো থেকে লন্ডন যাত্রা করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সোভিয়েত সফর–সম্পর্কিত ব্যবস্থা করার জন্য গত সপ্তাহে তিনি মস্কো যান। ইন্দিরা গান্ধী চলে যাওয়ার পরও তিনি সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য মস্কো থেকে যান। লন্ডন যাত্রার আগে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ রাশিয়া বিভাগের মন্ত্রী এ এ কোমিভের সঙ্গে আলোচনা করেন।

পাকিস্তানের তৎপরতা

পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত চীনের কনসাল জেনারেল চ্যাং ইং এ দিন ঢাকায় চীনের ২২তম বার্ষিক দিবস উপলক্ষে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, বাইরের কোনো শক্তি পাকিস্তান আক্রমণ করলে তার দেশ পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে। অনুষ্ঠানে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরাসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি যোগ দেন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা; দ্য টেলিগ্রাফ, যুক্তরাজ্য, ১ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ২ ও ৩ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান