বিজ্ঞাপন
default-image

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের কিছু সদস্য ২১ সেপ্টেম্বর মুজিবনগর থেকে কলকাতা ও দিল্লি হয়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁরা সেখানে বাংলাদেশের বক্তব্য তুলে ধরবেন এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রচারণা চালাবেন।

এদিন যাত্রা করেন সৈয়দ আবদুস সুলতান, ফণীভূষণ মজুমদার, মফিজ চৌধুরী, আসহাব-উল হক, ফকির সাহাবুদ্দীন, খুররম খান পন্নী ও আবুল ফতেহ। কয়েকজন সদস্য আগেই নিউইয়র্কে পৌঁছান। দলটিকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে। তিনি নিউইয়র্কে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মিলিত হবেন।

অভূতপূর্ব মানবিক সমস্যা

নিউইয়র্কে জাতিসংঘ কার্যালয়ে ৭৪টি জোটনিরপেক্ষ দেশের প্রতিনিধিদল একটি খসড়া ইশতেহার তৈরি করে। তাতে বলা হয়, ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীরা এক ‘অভূতপূর্ব মানবিক সমস্যা’ সৃষ্টি করেছে। তাদের মনে আস্থা জাগাতে এবং তাদের দ্রুত নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ গড়ে তুলতে ইশতেহারে আহ্বান জানানো হয়। জাম্বিয়ার রাষ্ট্রদূত খসড়া তৈরির অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর এক সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছে এটি পেশ করা হবে।

কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি ব্যাপকতর রাজনৈতিক পরিসরে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু মরক্কোসহ কয়েকটি সদস্যদেশ আপত্তি জানিয়ে বলে, পাকিস্তানের অনুপস্থিতিতে এই আলোচনা যুক্তিযুক্ত নয়।

বাংলাদেশের স্বীকৃতি: যুক্তরাজ্যের সাংসদদের স্বাক্ষর

যুক্তরাজ্যের কমন্স সভার লেবার পার্টির সদস্য ফ্রেড ইভান্স এদিন কলকাতায় সাংবাদিকদের জানান, কমন্স সভার সদস্যরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে প্রায় ২২০ জন সদস্য স্বাক্ষর করেছেন। তিনি জানান, তাঁরা প্রায় ৩০০ জনের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারবেন। ব্রিটেনে সাংসদদের মোট সংখ্যা ৬৩০।

ফ্রেড ইভান্স বাংলাদেশ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে গিয়ে ২১ সেপ্টেম্বর শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর দেশের মানুষ বাংলাদেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে একমত। ব্রিটেনের গণমাধ্যম এ ব্যাপারে সোচ্চার। সারা বিশ্বেই বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে উঠছে।

দিল্লিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ এদিন লন্ডনে সদর দপ্তর করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মৈত্রী কমিটি গঠনের কথা বলেন। এই কমিটি গঠন এবং তার চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার ক্ষমতা সম্মেলনের সভাপতি সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে দেওয়া হয়।

গেরিলা অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের শালদা নদী এলাকায় এদিন বড় যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল চাঁদলা থেকে নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণের লক্ষ্যে মন্দভাগের দিকে এগিয়ে আসে। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল শালদা নদীতে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনারা কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাসহ কয়েকজন হতাহত হয়। এই সেক্টরের গেরিলাদের আরেকটি বড় দল শরীয়তপুরের পালং থানায় অতর্কিতে হামলা করলে পাকিস্তান অনুগত কয়েকজন পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়। দু-তিনজন গেরিলা যোদ্ধাও আহত হন।

৬ নম্বর সেক্টরের রৌমারীর কোদালকাটিতেও বড় একটি যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনারা মর্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের চরকোদাল ক্যাম্প আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।

বরগুনা জেলায় ৯ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাথরঘাটা অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

শূন্য আসনে উপনির্বাচন

পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন এদিন আগে ঘোষিত সময়সূচি বাতিল করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনে উপনির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করে। নতুন সময়সূচি অনুসারে ভোট গ্রহণ ১২ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ২৩ ডিসেম্বর শেষ হবে। নির্বাচিত আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করে এই উপনির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম এক বিবৃতিতে বলেন, শরণার্থীদের নিয়ে ভারতের খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। তারা যাতে দেশে ফিরে আসতে পারে, তার জন্য ভারতকে বাধ্য করতে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে তিনি আবেদন জানিয়েছেন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, ছয় ও নয়; পূর্বদেশ, ঢাকা, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান