বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৩ জুন মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলোকে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের পক্ষে না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি অনুরোধ জানান।

তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারই দেশের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন প্রত্যাখ্যান করে জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান।

বাংলাদেশের পক্ষে–বিপক্ষে

লন্ডনে ১৩ জুন সন্ধ্যায় এক টিভি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ
সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের খবর চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিলেই এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে।

লন্ডনের যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বাংলাদেশ যুব সংঘের উদ্যোগে হাজারখানেক প্রবাসী বাঙালি বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভ শেষে তাঁরা দূতাবাসে স্মারকলিপি দেন। এই স্মারকলিপিতে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র বাংলাদেশের জনগণকে দমনে এবং গণতন্ত্রকে শ্বাসরোধ করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটেও স্মারকলিপি দেন।

যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস–এর এই দিনের সংখ্যায় ‘দুঃখের মিছিল’ শিরোনামে শরণার্থীদের মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী একটি কর্দমাক্ত শহর বারাসাত। জনসংখ্যা ২১ হাজার। দেড়-দুই লাখ লোক বানের জলের মতো এই বারাসাত শহরে ঢুকে পড়েছে। শহরের চারদিকে ধানি জমিতে তারা গিজগিজ করছে। স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল এবং পতিত জমিতে এদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়েছে।

পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদী লাহোরে বলেন, জাতীয় সম্মান ও মর্যাদা বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মুখের ওপর তাদের সাহায্য ছুড়ে দিয়ে মার্কিন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলা বলা উচিত পাকিস্তান সরকারের।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

সৈয়দপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তাদের আশ্রয়শিবির থেকে কিছু অবাঙালি হিন্দু পরিবারকে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে একটি ট্রেনে তোলে। ট্রেনটি সৈয়দপুর রেল কারখানার উত্তর পাশে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছালে ট্রেন থামিয়ে দরজা–জানালা আটকে দেওয়া হয়। এরপর দুই-তিনজন করে নামিয়ে গুলি চালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাদের হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞে ৩৩৮ জন নিহত হয়। ৬৫ জন পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন।

মৌলভীবাজারের শেরপুরের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। এ অভিযানে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্র হস্তগত করেন।

টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাসাইল থানা আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানিদের একজন সহযোগী ও একজন দারোগা নিহত হয়। প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

কুমিল্লার রাজাপুর রেলস্টেশনের পাশে পাঁচড়া গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, চার ও এগারো; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; ইত্তেফাক, ১৪ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ১৪ ও ১৫ জুন ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান