বিজ্ঞাপন
default-image

স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি জানিয়ে ২১ মে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া), যুক্তরাজ্য ও ভারত এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের হস্তক্ষেপ আহ্বান করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান সরকারের পক্ষে এই তথ্য জানিয়ে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলে তাঁরা স্থির নিশ্চিত।

বাংলাদেশ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দেওয়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা এই দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি নামে একটি সংগঠন গঠন করেন। এর সভাপতি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক। সমিতির লক্ষ্য বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের একত্র করে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা এবং জনমত গড়ে তোলাসহ শরণার্থী শিক্ষকদের সাময়িক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের কয়েক শ শিক্ষক সভায় যোগ দেন।

ভারতে স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধান হোসেন আলী এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য করা জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের আবেদনই বাংলাদেশের অস্বাভাবিক অবস্থার প্রমাণ। বাংলাদেশ পাকিস্তানি সেনামুক্ত হলেই শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবে।

শরণার্থীদের জন্য ব্রিটিশ সাহায্য

ব্রিটিশ সরকার ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ভারতীয় মুদ্রার সমপরিমাণ সাহায্যের কথা ঘোষণা করে। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব এদিনের আগের বুধবার যে আবেদন জানিয়েছিলেন, তাতে সাড়া দিয়ে এই সাহায্য দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের সাহায্যের প্রয়োজনের কথা বলেন। এ ছাড়া শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানান। জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহি একই বৈঠকে দেওয়া বক্তৃতায় পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং নারী-শিশুসহ বহু শরণার্থী ভারতে গিয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব সফররত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে বাংলাদেশের ঘটনাবলি তুলে ধরেন।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচিতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশত্যাগ করা মানুষের প্রচারণায় কান না দিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরুর জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের পূর্বাংশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জীবনযাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আগের দিন ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। তাঁর দৃঢ় ধারণা, দেশের বর্তমান সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। যাঁরা মনে করেন পাকিস্তানের দুই অংশেই একসঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত, তিনি তাঁদের সঙ্গে একমত নন।

দলের সহসভাপতি মাহমুদ আলী কাসুরি বলেন, যাঁরা বিদ্রোহ করেছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে অন্যরা এখনো জাতীয় পরিষদের সদস্য। ক্ষমতা হস্তান্তর কেবল কেন্দ্রেই হতে পারে। প্রদেশের দায়িত্ব শুধু ক্ষমতায় অংশগ্রহণ।

ঢাকায় নিয়োজিত চীনের কনসাল জেনারেল চ্যাং ইং বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে, তা পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শালদানদী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর খাদ্য ও রসদবাহী একটি রেলওয়ে ট্রলির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু গোলাবারুদ হস্তগত করেন।

কুমিল্লার দক্ষিণে গৌরীপুরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের ওপর ঝটিকা আক্রমণ করলে সেনাদলটির বেশ ক্ষতি হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল এই দিন কুমিল্লার দেবীদ্বার থানা আক্রমণ করে। এ অভিযানে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই; দৈনিক পাকিস্তান, ২২ ও ২৪ মে ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২২ মে ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান