বিজ্ঞাপন
default-image

বঙ্গবন্ধুর অবিলম্বে মুক্তির জন্য উদ্যোগী হয়ে পাকিস্তানের ওপর প্রভাব খাটানোর দাবিতে বাংলাদেশের শরণার্থী বুদ্ধিজীবীরা ১৩ আগস্ট সকালে কলকাতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এর আগে বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তি পরিষদ ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির আহ্বানে বুদ্ধিজীবীরা কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের সামনে এক সভায় মিলিত হন। এতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানুষের স্বার্থে এবং বিশ্ব শান্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তি প্রয়োজন।

সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুকে বিচারের প্রহসন করে হত্যা করার চেষ্টার তীব্র নিন্দা এবং জাতিসংঘ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে এ ব্যাপারে ইয়াহিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য আবেদন জানানো হয়। সভা শেষে তাঁরা মিছিল করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কনস্যুলেট অফিসে যান এবং সভায় গৃহীত প্রস্তাবের অনুলিপি কনস্যুলেটে পেশ করেন।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আবেদনে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়ে বলেন, তিনি যেন শেখ মুজিবের বিচারে ঔদার্য ও মানবিক বিবেচনা প্রদর্শন করেন।

বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে এ দিন ব্রিটেনের টাইমস পত্রিকায় হাউস অব কমন্সের দুজন সদস্য পিটার শোর এমপি এবং আইনবিদ ডব্লিউ টি উইলিয়ামস এমপির একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠিতে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, তিনিই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। ডব্লিউ টি উইলিয়ামস চিঠিতে বলেন, শেখ মুজিবকে বিচারের চেষ্টা পাকিস্তানের সামরিক চক্রের এটিই প্রথম নয়, এর আগেও তারা এ চেষ্টা করেছে। আইয়ুবের পতনের কারণে মুজিব সেবার মুক্তি পান। তখনই প্রমাণিত হয়, আইয়ুব চক্র নিষ্ঠুর উৎপীড়নের মাধ্যমে মিথ্যা সাক্ষ্য সাজিয়েছে। ফলে সরকারপক্ষের সামলা সাজানোকে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি বলে ঘোষণা করেছিলেন। ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র সেই বিচারের জেরই টানতে চাইছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের খবরে বিশ্বের নানা দেশের পত্রিকা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এ দিন মতামত প্রকাশ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টারক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার দৈনিক বেলগ্রেড বোরবা এবং ইন্দোনেশিয়ার ইংরেজি দৈনিক জাকার্তা টাইমস ইত্যাদি। তাদের মূল বক্তব্য ছিল, শেখ মুজিব একজন জনপ্রিয় নির্বাচিত নেতা। তাঁর অন্যায্য বিচার করা হলে ইয়াহিয়া তাঁর নিজের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথ চিরতরে হারিয়ে ফেলবেন। জেনেভা থেকে ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেসও ইসলামাবাদে পাঠানো এক তারবার্তায় বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

এডওয়ার্ড কেনেডির ভাষ্য

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দিল্লিতে বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে চরম মানবিক বিপর্যয় বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যাঁরা বাংলাদেশে সংঘটিত পৈশাচিক ঘটনাবলির বিবরণ শুনেছেন, তাঁদের পক্ষেও এর তীব্রতা ও ব্যাপ্তির কথা কল্পনা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের সদস্য হিসেবে তিনি পৃথিবীর শোচনীয়তম এই মানবিক বিপর্যয় সাহায্য করার উপায় খুঁজতে ভারতে এসেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। দেশে ফিরে তিনি সিনেট ও জনসাধারণকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাবেন।

ইন্দোনেশিয়া সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিক সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা যে আন্তর্জাতিক চেহারা পাচ্ছে এবং ভারতের ওপর যে চাপ পড়ছে, সে সম্পর্কে ইন্দোনেশিয়া অবগত।

ইয়াহিয়ার বড়াই

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দেশটির জাতীয় দিবস উপলক্ষে এ দিন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সংকট পাকিস্তানকে আরও শক্তিশালী ও গৌরবান্বিত করেছে। এই জাতীয় উৎসব এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়েছে, যখন নাশকতাকারী এবং বিদেশি আগ্রাসীরা দেশটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।

রেডিও পাকিস্তানের এক বিশেষ ঘোষণায় বলা হয়, ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সব ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে; সভা, সমাবেশ ও মিছিল বেআইনি করা হয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল এই দিন ঢাকা শহরের অদূরে ডেমরার কাছে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি জিপ অ্যামবুশ করলে জিপটি ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন বিমান-সেনা হতাহত হয়।

মুক্তিবাহিনীর আরেকটি গেরিলা দল নরসিংদীর ঘোড়াশালের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ঝিনারদি অবস্থানে আক্রমণ চালায়। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়, কয়েকজন আত্মসমর্পণ করে এবং কয়েকজন পালিয়ে যায়।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে দুই পক্ষে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। মুক্তিবাহিনীর ইপিআর সদস্য কবির আহমদ শহীদ হন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, তিন ও ছয়; দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ১৪ ও ১৫ আগস্ট ১৯৭১


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান