বিজ্ঞাপন
default-image

বিখ্যাত ফরাসি দৈনিক লা মঁদ পত্রিকায় ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, জনগণ যদি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য মার্জনা চায়, তাহলে তিনি তা মঞ্জুর করবেন। লা মঁদ-এর সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন, যে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গোপনে শেখ মুজিবের বিচার করছে, তারা যদি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট তাঁর মার্জনা করার অধিকার প্রয়োগ করবেন কি না। প্রশ্নের উত্তরে ইয়াহিয়া ওই কথা বলেন।

আরেক প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে নিরপরাধ ঘোষণা না করা পর্যন্ত তিনি একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত পাকিস্তানকে হুমকি দিচ্ছে।

বাংলাদেশ নিয়ে টিটো-ইন্দিরা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশটিতে সফররত যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে দিল্লিতে আলোচনাকালে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কোনো অভিপ্রায় ভারতের নেই। তবে ভারত আক্রান্ত হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা মোকাবিলা করবে। টিটোর সঙ্গে ইন্দিরার প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়। আলোচনায় মুখ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশ।

আলোচনায় মার্শাল টিটো কিছু বিষয়ে ইন্দিরার সঙ্গে একমত হন। ১. বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। ২. বাংলাদেশে শরণার্থীদের নিরুদ্বেগে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। ৩. প্রত্যেক মানুষেরই উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অধিকার আছে। ৪. দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার ভারতের আছে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ১৮ অক্টোবর আলাদা তিনটি স্থানে অভিযান চালান। প্রথম দল ফেনীর গুতুমা সীমান্তঘাঁটিতে, দ্বিতীয় দল গুতুমা নদী এলাকায় এবং তৃতীয় দল মাতুয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করে। তিন স্থানেই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার মিলে কয়েকজন হতাহত হয়। গুতুমা সীমান্তঘাঁটির যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। একজন পরে মারা যান।

২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী দল মর্টার ও রিকোয়েললেস রাইফেলের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর চৌদ্দগ্রামের বাডিসা ঘাটের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। প্রায় একই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর রাজাসার দীঘির অবস্থানে হামলা করলে পাকিস্তানি বাহিনীর দু-তিনজন হতাহত এবং কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দভাগ বাজারের পশ্চিম দিকে দেউশে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা চাপিতলায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের পেছন দিকে অ্যামবুশ পাতে। ভোর চারটায় পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি দল তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলো শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে এসে পড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।

৫ নম্বর সেক্টরের ভোলাগঞ্জ সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ২৫টি নৌকায় করে গৌরীনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণের উদ্দেশে রওনা দেয়। তারা গৌরীনগরের কাছাকাছি এলে পাকিস্তানি বাহিনী গৌরীনগর থেকে তাদের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। অকস্মাৎ এ আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ছয়জন গুরুতর আহত হন।

এই সেক্টরের সুনামগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনী সংঘবদ্ধ হয়ে ছনখাইড় এলাকায় এসে পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানিরা আর এগোতে না পেরে ছাতকের দিকে ফিরে যায়। তবে পাকিস্তানি সেনারা ছনখাইড়, রাজারগাঁও, মৌলা, জয়নগর, জোড়াপানি, নোয়ারাই ইত্যাদি গ্রামের বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করেন। দুটি দল ঝিনাইদহের ফতেহপুর ও ধেনকিপাতায় পাকিস্তানি বাহিনীর আলাদা দুটি দলকে অ্যামবুশ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল সাদীপুরে একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, পাঁচ ও আট; সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, সম্পাদনা মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৯ ও ২০ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান