সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদা ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনাবলির বিস্তারিত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়। প্রতিবেদনে প্রাভদা বলে, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ও নৃশংস গণহত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে পাকিস্তানের প্রশাসন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের তামাশা করছে। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছে।
প্রাভদা জানায়, ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হওয়ায় সোভিয়েত জনগণ বিক্ষুব্ধভাবে এর প্রতিবাদ করছে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি, পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনেরও দাবি করছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক বিতর্কে প্রায় ১০০ দেশের প্রতিনিধি এ পর্যন্ত বক্তব্য দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৫০টি দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান এবং শৃঙ্খলার প্রত্যাবর্তন কামনা করছে। তবে সে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান কী, তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্রিটেন, মিসর, সিরিয়া, তুরস্ক ও জর্ডানের প্রতিনিধিরা বলেন, মীমাংসা পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে হওয়া উচিত। মিয়ানমারের প্রতিনিধিও বাংলাদেশ সমস্যার কথা এড়িয়ে যান। নেপালের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সমস্যার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেন, এর সমাধানের জন্য উচ্চ স্তরের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দরকার। চীনের ঘনিষ্ঠ আলজেরিয়ার প্রতিনিধি বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষ কোনো বক্তব্য দেননি।
ভ্যাটিকানের পোপ জন পলের আহ্বানে রোমের বিভিন্ন গির্জায় বাংলাদেশের জন্য বিশেষ প্রার্থনাসভা আয়োজনের পাশাপাশি উপবাস পালন করা হয়। প্রার্থনাসভায় শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সোহরাওয়ার্দী-পুত্র
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী লন্ডনে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এর সাফল্য কামনা করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিষয়টি জানতে পারার পর থেকেই বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তাঁর সম্পূর্ণ সহমর্মিতা ও সমর্থন ছিল। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ও নির্দ্বিধায় বলেন, বিগত ২৪ বছর ধরে বাঙালিরা অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত ও রাজনৈতিকভাবে অবদমিত হয়ে আসছে। এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত গণহত্যা এবং অন্যান্য ঘৃণ্য অনাচারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই সংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই। নিকট ভবিষ্যতে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে তাঁর এই বিবৃতি এ দিন সাংবাদিকদের কাছে বিতরণ করা হয়।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ১০ অক্টোবর ফেনীতে অভিযান পরিচালনা করে। একটি দল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী বাংলাবাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। অন্য দলটির সঙ্গে শুভপুর এলাকায় একদল পাকিস্তানি সেনার গুলিবিনিময় হয়।
পাকিস্তানি রেঞ্জার পুলিশের একটি দল লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জ যাওয়ার সময় এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা তাদের অতর্কিতে হামলা করে কয়েকজনকে হতাহত করেন।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা জেলার আজনাপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা রেলস্টেশনের কাছে রেললাইনে মাইন পেতে রাখেন। মাইনের বিস্ফোরণে পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকারবাহী একটি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ কয়েকটি বগি রেললাইন থেকে ছিটকে পড়ে। এতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাবসেক্টরে একদল মুক্তিযোদ্ধা একদল পাকিস্তানি সেনাকে অ্যামবুশ করে। তাতে কয়েকজন হতাহত এবং দুজন রাজাকার বন্দী হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর মাধবকাঠি অবস্থানে এই সেক্টরের গোজাডাঙা সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
ভুট্টোর মেকি মনস্তাপ
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পিপিপি প্রতিনিধিদলের পূর্ব পাকিস্তান সফর উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশে দেওয়া এক বাণীতে বলেন, তাঁর দল আট মাস ধরে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি গভীর মনস্তাপ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে। বহু রক্তপাত ঘটেছে এবং পাকিস্তানিদের পাকিস্তানিকে হত্যার করুণ ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছে। পাকিস্তানিদের অবশ্যই পাকিস্তানি হত্যা বন্ধ করতে হবে এবং সবাইকে শুভেচ্ছা ও মহানুভবতা নিয়ে শান্তির সঙ্গে বাস করতে হবে। ভুট্টো দাবি করেন, তাঁর দলই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের মতকে যথোপযুক্ত মূল্য দিতে হবে বলে ঘোষণা করেছিল।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, খণ্ড দশ; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক ও দুই; দ্য সানডে টাইমস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১০ অক্টোবর ১৯৭১; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১১ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ১১ ও ১২ অক্টোবর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান