ব্রিটেনের ব্রাইটনে দেশটির লেবার পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে এদিন বাংলাদেশের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ ও ভীতি প্রকাশ করে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে সামরিক শক্তি ব্যবহারের জন্য পাকিস্তান সরকারের নিন্দা করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত জরুরি মানবিক সাহায্য ছাড়া বিশ্বের সব দেশকে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করতে অনুরোধ করা হয়।
ওই প্রস্তাবে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে এবং পাকিস্তান সরকারকে জরুরি মানবিক কর্মসূচির সঙ্গে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানানো হয়। বাংলাদেশে অবিলম্বে সামরিক উৎপীড়ন বন্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে বলা হয়। এ ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবিলম্বে আলোচনা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ইয়ান মিকার্ডো প্রস্তাবটি পেশ করেন। প্রস্তাবের সমর্থনে সাবেক মন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট, ব্রুস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউসসহ আরও কয়েকজন বক্তব্য দেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা এদিন ‘পূর্ববঙ্গে লাখ লাখ লোকের ট্র্যাজেডি’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে বাংলাদেশে ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের কাজে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ ও ভর্ৎসনা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের বিবৃতিও প্রাভদায় প্রকাশিত হয়। এসব বিবৃতিতেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাজের সমালোচনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য দপ্তরের চেয়ারম্যান ডা. কার্ল টেলর দেশটির প্রতিনিধি পরিষদের (কংগ্রেস) আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংক্রান্ত কমিটির কাছে বলেন, জাহাজ বোঝাই অস্ত্র পাকিস্তানকে সরবরাহ করায় যারা যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করছে, তারা ঠিকই করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে নতুন শরণার্থী স্রোত আসছে। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানে আগামী দিনে অনেক লোককে অনাহারে কাটাতে হবে। সুতরাং আরও কয়েক লাখ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে আসার চেষ্টা করবে।
আরেক বাঙালি কূটনীতিকের পদত্যাগ
লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি রাজনৈতিক কাউন্সেলর রেজাউল করিম এদিন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পরে তিনি লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনে যোগ দেন। লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে তখন পর্যন্ত যেসব বাঙালি কূটনীতিক ও কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন, তাঁদের মধ্যে রেজাউল করিমই সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল এদিন ফেনী মহকুমার বিলোনিয়া-ছাগলনাইয়া সড়কে দুটি পৃথক স্থানে অভিযান চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল টহলরত পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর আঘাত হানলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। তবে তারা শক্তি সঞ্চয় করে কিছুক্ষণ পর আবার মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি। মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল এই সড়কের একটি সেতু ধ্বংস করে। বিলোনিয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের একটি অংশকে ছাগলনাইয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা এই সেতু ধ্বংস করেন।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনীর ছাগলনাইয়া থানার রাধানগর তহশিল অফিস ও মোকামিয়ায় পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করেন। এতে দুই পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের বক্তব্য সমর্থন
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান শেষে এদিন দিল্লি ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের এর আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানই শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরার পথ প্রশস্ত করতে পারে। ভারতের এই বক্তব্যের বিপুল সমর্থন মিলেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে সামরিক উৎপীড়ন চালানো হচ্ছে, সেটাকে ঘরোয়া ব্যাপার বলে ধামাচাপা দেওয়ার পাকিস্তানি অপচেষ্টা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী খারিজ করে দিয়েছে।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান সরকার এদিন ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির সমালোচনা করে বলে, এর ফলে ভারত এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণামূলক কাজে উৎসাহ পাচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের জঙ্গি সরকারের নির্যাতনের নিন্দা করে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন সম্প্রতি যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র তা অগ্রাহ্য করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফরকালে তাঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় কোসিগিন ওই বিবৃতি দেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক তাঁর মন্ত্রিসভায় আরও তিন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁরা হলেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) এ কে মোশারফ হোসেন ও জসিম উদ্দিন আহমদ এবং কাইয়ূম মুসলিম লীগের অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক ও দুই; দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য টাইমস, লন্ডন, ৮ অক্টোবর ১৯৭১; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৮ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ৮ ও ৯ অক্টোবর ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান