২৩ মার্চ ছিল ‘পাকিস্তান দিবস’। কিন্তু একাত্তরের এই দিনে সারা বাংলায় উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনানিবাস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ওড়েনি। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’ পালনের নামে প্রকৃতপক্ষে দিনটিকে বাংলাদেশ দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে।
ঢাকায় সচিবালয়, হাইকোর্ট ও জাতীয় পরিষদ ভবন, ইপিআর ও পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিফোন ভবন, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ও প্রদেশের মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হয়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পাকিস্তানি সেনাদের বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ঢাকার ব্রিটিশ উপহাইকমিশন ও সোভিয়েত কনস্যুলেটে ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা। চীন, ইরান, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার উপদূতাবাসে প্রথমে পাকিস্তানি পতাকা তোলা হয়। পরে জনতা সেসব নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। মার্কিন কনস্যুলেটে কোনো পতাকাই তোলা হয়নি।
সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় সমবেত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি পরিবেশন করা হয়। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় পতাকাকে অভিবাদন জানান। বঙ্গবন্ধু তাঁদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। সূর্যাস্তের সময় স্বেচ্ছাসেবকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা নামিয়ে নেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের শীর্ষে যথারীতি কালো পতাকাও ওড়ে।
সকাল থেকে রাত অব্দি ঢাকার রাজপথ সংগ্রামী জনতার মিছিলে প্রকম্পিত হয়। মিছিলে অংশ নেওয়া নারী-পুরুষ-শিশু সবার হাতে ছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করে। বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে মানুষ সুশৃঙ্খল মিছিল করে শেখ মুজিবের বাসভবনের সামনে আসতে থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ দিবসটি ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করে। বায়তুল মোকাররম, পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, নিউমার্কেট থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত পুরো এলাকা মিছিলে মিছিলে ছেয়ে যায়। শেখ মুজিবের বাসভবন এলাকা থেকে শুরু করে প্রশস্ত মিরপুর সড়ক উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মুক্তিকাতর জনতা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে পতাকা হাতে নেয়। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা আন্দোলিত করে তাদের অভিনন্দিত করেন।
ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা তোলার পর প্রভাতফেরি বের করে। আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবর জিয়ারত শেষে শহীদ মিনারে ফুলের মালা দেয়। সকাল সোয়া নয়টায় আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রছাত্রী ও সাবেক বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত জয় বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া। হাজার হাজার মানুষের করতালির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার পর বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় পতাকাকে অভিবাদন জানান। এ সময় রেকর্ডে বাজছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এরপর তারা কুচকাওয়াজ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তাঁকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানান।
নানামুখী তৎপরতা: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সেনানিবাসে গিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সৈনিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তাঁর যাওয়া-আসার সময় পথের দুই পাশে জনতা বিক্ষোভ জানায়।
আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন এদিন ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা, এম এ আহমেদের সঙ্গে দুপুরে ও সন্ধ্যায় দুই দফা বৈঠকে মিলিত হন।
সকালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদার সঙ্গেও বৈঠক করেন। ভুট্টো প্রায় সারা দিন দলীয় উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করেন।
মুসলিম লীগের নেতা খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৩ মার্চ করাচি থেকে ঢাকায় এসেই ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বিকেলে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গেও আলোচনা করেন। কাইয়ুম খান সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের মানুষকেই বলতে হবে, দেশকে অখণ্ড রেখে তারা কতটুকু স্বায়ত্তশাসন আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কতটুকু সম্পর্ক রাখতে চায়। যদিও ভোটের মাধ্যমে তারা জানিয়ে দিয়েছে, তাদের প্রত্যাশা সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।
সন্ধ্যায় খান আবদুল ওয়ালি খান, মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, মুফতি মাহমুদ, গাউস বক্স বেজেঞ্জো, শাহ আহমদ নুরানি ও সরদার শওকত প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে মুফতি-ওয়ালি-বেজেঞ্জো যৌথ বিবৃতিতে বলেন, দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর জনসাধারণ যখন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন থেকেই প্রতারণাপূর্ণ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
এদিন করাচিতে ভুট্টো সমর্থকেরা বাঙালি কলোনিতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ, গুলিবর্ষণ ও লুটতরাজ করে। বেশ কয়েকজন বাঙালি এতে হতাহত হয়।
পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ২৩ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি সামরিক বিমানে করে গোপনে ঢাকা সফর করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা কাইয়ুম খান। ফারল্যান্ড সেদিনই পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান।
সূত্র: ইত্তেফাক, পূর্বদেশ ও সংবাদ, ২৪ মার্চ ১৯৭১; মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, একাত্তরের ডায়ারী, আলমগীর কবির।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।