বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সভাপতি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়। সভায় নেওয়া এক প্রস্তাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা ও অত্যাচার বন্ধ করতে জাতিসংঘ ও বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানানোসহ দরকারি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হয়। সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতে ১১ এপ্রিল কলকাতায় জনসভা করা নিয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করতে কলকাতার ভারতীয় সংস্কৃতি ভবনে অন্য সভায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের নিয়ে গঠন করা হয় সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি নামে আরেকটি সংগঠন। এর সভাপতি নির্বাচিত হন কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কোষাধ্যক্ষ ও যুগ্ম সম্পাদক হন যথাক্রমে সন্তোষকুমার ঘোষ ও বিনয় সরকার। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সঙ্গে যোগ রেখে এই সমিতি কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন মনোজ বসু ও প্রবোধকুমার সান্যালসহ বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এই সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সংগঠন মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেয়। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখা রক্তদান কর্মসূচির ডাক দেয়। ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান রিলেশনসের এক সভায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার নিন্দা করা হয়। কলকাতা বন্দরের শ্রমিক, জাহাজমালিক, নিয়োগকর্তা কর্মকর্তা ও কর্মীদের এক সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। কলকাতা বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। বঙ্গীয় ব্যাংক কর্মী অ্যাসোসিয়েশনের কর্মীরা মুক্তিযোদ্ধাদের এক দিনের বেতন দেওয়ার কথা জানিয়ে বিবৃতি দেন। কলকাতার একদল মেডিকেল ছাত্র চুয়াডাঙ্গা-দর্শনায় মেডিকেল মিশনে যান।

যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় আলোচনা

যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হয়। কমন্স সভার কয়েকজন সদস্য আলোচনায় বাংলাদেশে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করেন। এর আগে পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক সচিব অ্যালেক ডগলাস হোম বিবৃতি দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণ অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন। পাকিস্তানের জনগণের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি এবং দুর্দশায় তাঁরা উদ্বিগ্ন বলে জানান। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের বিবৃতির সূত্রে পাকিস্তান সরকারের অনুরোধে পরিচালিত যেকোনো আন্তর্জাতিক মানবিক প্রয়াসের প্রতি তাঁরা সহানুভূতিশীল।

সামরিক কর্তৃপক্ষের সচলতা

পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এ দিন ঢাকায় ঘোষণা করে, প্রদেশের পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। পাকিস্তানবিরোধীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ঢাকায় কারফিউর মেয়াদ এ দিন ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। এ সময় নাগরিকেরা দলে দলে নগরী ত্যাগ করেন।

পাকিস্তানপন্থী বাঙালি নেতাদের তৎপরতা

পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন এবং দলের আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা মৌলভি ফরিদ আহমদ পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র থেকে আলাদাভাবে বেতার ভাষণ দেন। বাংলাদেশের সব বেতারকেন্দ্র থেকে তাঁদের ভাষণ প্রচারিত হয়।

ভাষণে নুরুল আমিন বলেন, ভারতের লোকসভায় প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর দেশের পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য প্রকাশ্যে উসকানি দেওয়া হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর এমন হস্তক্ষেপ বরদাশত করা হবে না।

মৌলভি ফরিদ আহমদ তাঁর বেতার ভাষণে বলেন, জনগণের একটি অংশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে কোনো নতুন সমস্যা সৃষ্টিতে উৎসাহিত না হলে বেদনাদায়ক শক্তি প্রদর্শনের সামান্যতম প্রয়োজনও হতো না। কিন্তু ভারতীয় বেতার থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের বহু অংশে প্রাধান্য লাভ করছে।

কাইয়ুম মুসলিম লীগের সাবেক মহাসচিব খান এ সবুর খান আরেকটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলেন, শেখ মুজিবের ৬ দফা পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার একটি অতিসূক্ষ্ম পদ্ধতি। ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠাচ্ছে এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে মদদ জোগাচ্ছে।


সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড; দৈনিক পাকিস্তান, ৬ এপ্রিল ১৯৭১।