মুজিবনগরে একটি মহল ২৮ নভেম্বর জানায়, বাংলাদেশ সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সেটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার জন্য পশ্চিমা কিছু দেশ তৎপর। ভারত উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় বেলজিয়াম নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার যে প্রস্তাব তুলতে চায়, তাতে ইতালি যোগ দিয়েছে। জাপানকেও তারা টানতে চাইছে। কিন্তু জাপান চায়, বৃহৎ শক্তিরা নেপথ্যে তৎপর হয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুক।
আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ইঙ্গিত দিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সমস্যার অজুহাতে বৃহৎ শক্তিদের অথবা নিরাপত্তা পরিষদকে জড়ানোর চেষ্টা করা হলে তারা বিরোধিতা করবে। তারা বারবার বলেছে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং এর দুই পক্ষ হলো পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্য কয়েকটি দেশের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল অংশ এই জটিল পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান সপ্তাহব্যাপী মুক্তাঞ্চল সফর শেষে মুজিবনগরে ফিরে বলেন, তিনি সেখানে প্রশাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রতিটি স্তরে কর্মকর্তা নিয়োগের তালিকা কিছুদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান।
সিলেট অঞ্চলে রাধানগর কমপ্লেক্সের ছোটখেল এলাকায় এদিন জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানির কিছু বেশি মুক্তিযোদ্ধা ভোরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা করেন। প্রথাগত যুদ্ধের নিয়মে আক্রমণে তিন গুণ যোদ্ধা প্রয়োজন হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য মনোবলের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী সতীর্থদের লাশ ফেলে দ্রুত রাধানগরের দিকে চলে যায়।
সকালে পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এ সময় তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) আহত হন। পাকিস্তানিদের উপর্যুপরি আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতায় ব্যর্থ হয়। যুদ্ধ চলতে থাকে।
পশ্চিমা মনোভাবের নিন্দা
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রশ্ন নিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মনোভাবের তীব্র নিন্দা করে। প্রাভদার অভিযোগ, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার উপেক্ষা করে পশ্চিমা শক্তিবর্গ ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে। প্রাভদায় আরও বলা হয়, পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং সংরক্ষিত সেনাবাহিনীকে তলব করে গোটা পরিস্থিতি জটিলতর করে তোলা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এপি ও রয়টার্সের খবরে এদিন বলা হয়, পাকিস্তানকে তার স্বীকৃত অন্যায় থেকে বাঁচানোর জন্য এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত-পাকিস্তানকে এক কোঠায় ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আবার নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি ভারত, পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে অভিন্ন বার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, যুদ্ধ যাতে না বাধে, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে; পূর্ব বাংলায় ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনা সংঘর্ষ বন্ধ করতে হবে এবং সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সেনা সরিয়ে নিতে হবে।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাঞ্জাবের কয়েকটি স্থান ও জয়পুরে দেওয়া ভাষণে বলেন, কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি উল্লেখ করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এর আগে ভারত তিনবার পাকিস্তানের কাছ থেকে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু কোনোবারই নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্টভাবে বলেনি যে ভারত আক্রান্ত হয়েছে। তাদের কাছে সুবিচার আশা করা যায় না।
সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য জ্যোতি বসু কানপুরে বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে তাঁর দল সরকারকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানাবে। বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছেন। পূর্ব বাংলার বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, জ্যোতি বসু চীনের এই অভিমতের স্পষ্ট বিরোধিতা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ কলকাতায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে পূর্ব বাংলায় যা চলছে, তাতে পাকিস্তান সেটিকে হারাতে বাধ্য হবে। পাকিস্তানের উভয় অংশের ঐক্য আর কল্পনাও করা যায় না। শরণার্থীরা জন্মভূমিতে ফিরে গেলেই বর্তমান সমস্যার সমাধান হতে পারে।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন আবার রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। গত তিন দিনে এ নিয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়া দুবার বৈঠক হয়। ভুট্টো জানান, প্রেসিডেন্ট তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ অবহিত করেছেন।
বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন বলে সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র এদিন প্রথমবারের মতো স্বীকার করে। পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করছে বলে একজন সামরিক মুখপাত্র বলেন। যদিও পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতিকে ভিয়েতনামের গণযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না বলে সেই মুখপাত্র মন্তব্য করেন।
সূত্র: রাধানগর যুদ্ধ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এস আই এম নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম, প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১৩; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৯ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৯ ও ৩০ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ২৯ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান