বিজ্ঞাপন
default-image

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার আলোকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ দলের হাইকমান্ডের সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠন করেন। এরপর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ এপ্রিল রাতে তিনি ভাষণ দেন। ভাষণটি স্বাধীন বাংলা বেতারের গোপন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। তাঁর এই বেতার ভাষণ থেকে সবাই জানতে পারেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে।

পরদিন ১১ এপ্রিল আকাশবাণী থেকে ভাষণটি একাধিকবার প্রচার করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আর তার সাড়ে সাত কোটি সন্তান এখন চূড়ান্ত সংগ্রামে নিয়োজিত।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য বাংলাদেশকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করা। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামে ধর্ম, মত, শ্রেণি বা দল নেই। আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালি।’

তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সব রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী, সমৃদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ কায়েমে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এ সংগ্রাম সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম, এ সংগ্রাম আজাদী ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। আজ আপনার–আমার একমাত্র কর্তব্য নিজের যথাসর্বস্ব দিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা। আমাদের ঐক্য বজায় থাকলে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কেন, দুনিয়ায় এমন কোনো শক্তিই আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পারবে না।’

তেলিয়াপাড়ায় প্রতিরোধযোদ্ধাদের আবার বৈঠক

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ার চা–বাগানে আবার বৈঠকে বসেন। বৈঠকে কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান রামগড় থেকে এসে বৈঠকে যোগ দেন। ওসমানী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলা প্রতিহত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল নজর রেখেছিল যশোর সেনানিবাসের দিকে। রাতে সুবেদার আহাম্মেদ উল্লাহ স্বল্পসংখ্যক সেনা নিয়ে প্রায় আট মাইল পথ অতিক্রম করে এসে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের বেশ কিছু কালভার্ট ধ্বংস করে দেন।

কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার (বর্তমানে উপজেলা) উত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা একটি পাকিস্তানি সেনাবহরে ঝটিকা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবহরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

পাকিস্তানের তৎপরতা

১০ এপ্রিল পাকিস্তান সরকার ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন থেকে বেতার ট্রান্সমিটার অপসারণের নির্দেশ দেয়। পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ইসলামাবাদের ভারতীয় হাইকমিশনে দেওয়া নোটে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার জানতে পেরেছে, ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন কার্যালয়ে একটি বেতার যোগাযোগযন্ত্র কাজ করছে। কিন্তু সরকার ভারতের হাইকমিশন বা উপহাইকমিশনকে কোনো বেতার ট্রান্সমিটার চালানোর অনুমতি দেয়নি।

পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে টেলিফোন সংযোগ আংশিক চালু করার ঘোষণা দেয়। তারা ঘোষণা দেয়, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ ব্যবস্থা ক্রমশ চালু হচ্ছে।

প্রাদেশিক জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকায় এক বেতার ভাষণে বলেন, ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ছেলে এবং জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য এ কে ফায়জুল হক এবং শেরেবাংলার মেয়ে ও জমিয়াতুল ইসলামীর সভানেত্রী রইসি বেগম ঢাকায় পৃথক বিবৃতিতে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানান। আরও কিছু ইসলামি দলের রাজনৈতিক নেতা পাকিস্তানের সামরিক সরকারের পক্ষে বিবৃতি দেন।

বাংলাদেশের পক্ষে সমাবেশ ও মিছিল

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে বড় একটি সমাবেশে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসহ সব রকমের সাহায্য দেওয়ার দাবি জানানো হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এমএলএ দীনেশ মজুমদার। প্রস্তাব পেশ করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বক্তব্য দেন বিমান বসু, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী প্রমুখ।

কলকাতায় ছাত্র-যুবকেরা পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে মিছিল করেন। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মীরা পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানান।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, তৃতীয় ও দ্বাদশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, আমীর-উল ইসলাম, (কাগজ প্রকাশন); রক্তে ভেজা একাত্তর, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, (সাহিত্য প্রকাশ); দৈনিক পাকিস্তান, ১১ এপ্রিল ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান