বিজ্ঞাপন
default-image

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা হয়ে ৩০ মার্চ সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পৌঁছান। সেখানে থেকে তাঁরা স্থানীয় বিএসএফের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় তাঁরা জানান, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতা হিসেবে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার করার জন্য ভারতে প্রবেশ করতে চান। ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানালে তাঁরা ভারতে প্রবেশ করতে রাজি আছেন।

বার্তা পাঠানোর পর ঘণ্টা কয়েক পর স্থানীয় বিএসএফ কমান্ডার এসে তাঁদের বিএসএফের ছাউনিতে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে যান কলকাতায় দমদম বিমানবন্দরে।

গভীর রাতে তাঁরা যখন কলকাতায় গিয়ে পৌঁছান, তখন ৩১ মার্চের প্রথম প্রহর। সেখানে বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান কে এফ রুস্তমজীর সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। তিনি তাঁদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

চট্টগ্রামের পতন

পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের অধিকাংশ সেনানিবাস ও ছাউনি ৩১ মার্চ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে সরে যান। এই দিনটিতেও বহু জেলা ও মহকুমা শহর মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিপুল সংখ্যায় মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।

৩০ মার্চ গভীর রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে মুহুর্মুহু আক্রমণ করতে শুরু করে। তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের তীব্র আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।

ভারতের একাত্মতা ও সংহতি

দিল্লিতে লোকসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিজের, ভারতের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূখণ্ডের একেবারে সন্নিকটে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের ওপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন চালানো হচ্ছে, আমাদের জনগণ তার তীব্র নিন্দা না জানিয়ে পারে না।’

বিবৃতিতে ইন্দিরা গান্ধী অবিলম্বে পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবি জানান। এ জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জরুরি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সারা বিশ্বের জনগণ ও সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।

ভারতের লোকসভা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করে। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনায় লোকসভা গভীরভাবে দুঃখিত ও উদ্বিগ্ন। ভারতের সীমানার এত কাছের ন্যক্কারজনক বিয়োগান্ত ঘটনায় লোকসভা উদাসীন থাকতে পারে না। নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চলছে, ভারতের জনগণ দ্বিধাহীন ভাষায় তার নিন্দা করছেন।

একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য পূর্ববঙ্গের জনগণের সূচিত সংগ্রামের প্রতি লোকসভার অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে। গণহত্যার শামিল এ সুপরিকল্পিত হত্যা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য লোকসভা বিশ্ববাসী ও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের কাছে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানায়।

লোকসভা আশ্বাস দিয়ে বলে, বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম ও ত্যাগ ভারতের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সহৃদয় সহানুভূতি পাবে।

বাংলাদেশের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গে হরতাল

বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে ৩১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গজুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হয়। কোনো ট্রেন চলেনি। বিমানও নয়। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনটিকে শোক দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।

সকালে ও বিকেলে অনেক মিছিল বের হয়। যুব কংগ্রেস পালন করে অনশন।


কুষ্টিয়ায় বীরত্বপূর্ণ জয়

কুষ্টিয়ায় আগের দিন শুরু হওয়া যুদ্ধ এই দিনও অব্যাহত ছিল। দিনভর যুদ্ধ শেষে জীবিত পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা ছিল ৪০-৪৫। রাতের আঁধারে তারা দুটি জিপ ও একটি গাড়িতে করে ঝিনাইদহের দিকে পালাতে চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা শৈলকুপার সেতুর গোড়ায় গর্ত খুঁড়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। তাদের প্রথম দুটি জিপ সেই গর্তে পড়ে মেজর শোয়েবসহ কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। বাকিরা আশপাশের গ্রামে পালিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ জনতা শত্রুসেনাদের নিশ্চিহ্ন করে। তাদের হাতিয়ার মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জমা দেওয়া হয়।

রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ জনতার হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে ঝিনাইদহে পাঠানো হয়। পরদিন ১ এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি যোদ্ধাদের প্রথম এই গুরুত্বপূর্ণ বীরত্বগাথা নিয়ে ড্যান কগিন ১৯ এপ্রিল সংখ্যা টাইম ম্যাগাজিন-এ প্রচ্ছদকাহিনি লেখেন।

যশোরের সালুয়া বাজার ও চৌগাছায় প্রতিরোধযুদ্ধ

মাছলিয়া সীমান্ত ক্যাম্পের একমাত্র বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদের নির্দেশনায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা ও ইপিআর সেনারা প্রথমে সালুয়া বাজার এবং পরে চৌগাছায় যশোর সেনানিবাসের দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক তারা রাস্তাঘাট অচল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। সুবেদার আহাম্মেদ উল্লাহ তাঁর দল নিয়ে যশোর-কুষ্টিয়া সড়কের হজরতপুর সেতু উড়িয়ে দেন।

কুষ্টিয়া ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক বাঙালি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রথম ইস্ট বেঙ্গলকে দেন। তিনি তাদের দুটি সামরিক জিপ, কয়েকটি হেভি মেশিনগান, ট্যাংক বিধ্বংসী কামান এবং গোলাবারুদও জোগাড় করে দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতি

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলে, ইসলামাবাদে দূতাবাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তার কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ, তাঁরা জানতে পেরেছেন যে মার্কিন সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের বৈধ কার্যক্রমে অসংগতভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড; লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, (অনন্যা); মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, আমীর-উল ইসলাম, (কাগজ প্রকাশন); সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, সম্পাদনা: মতিউর রহমান, (প্রথমা প্রকাশন); সৈনিক জীবন: গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর, হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, (প্রথমা প্রকাশন); দৈনিক পাকিস্তান, ৪ এপ্রিল ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান