বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ৩০ আগস্ট মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ সরকারি দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এক দিন আগে এ আলোচনা শুরু হয়। তাঁরা কয়েক দফা আলোচনা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে এই প্রথম ভারত সরকারের একজন উচ্চপদস্থ প্রতিনিধির আলাপ হলো।

ডি পি ধর নিজে এ খবর কলকাতায় সাংবাদিকদের জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার নানা দিক বোঝার জন্যই বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে এই আলোচনা। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একসঙ্গে বসে প্রস্তাব করেছেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো মীমাংসা নেই। বাংলাদেশে সরকার একটি স্বাধীন সরকার। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝা গেছে, পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো রফার কথা তাঁরা ভাবছেন না। তাঁদের প্রতি ভারতের পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে।

default-image

যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির সাংসদ পিটার শোরও এদিন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশের মুক্তির জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো কী করতে পারে, প্রধানত তা-ই ছিল তাঁদের আলোচনার বিষয়। দমদম বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শেখ মুজিবের তিনি মুক্তি চান। এই দিন রাতেই তিনি দিল্লি চলে যান।

স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিল্লিতে এদিন বাংলাদেশ মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। লন্ডনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় মিশন
হিসেবে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। মিশনটি উদ্বোধন করেন দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আমজাদুল হক। ইতিপূর্বে তাঁরা দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। আরও উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী দুই বাঙালি আবদুল মজিদ ও আবদুল করিম।

বাংলাদেশের পক্ষে সদ্য আনুগত্য প্রকাশকারী বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ লন্ডনে বলেন, বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোনো মিল নেই। বাংলাদেশ অবশ্যই পৃথক রাষ্ট্র হতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর বিচারে আইনে সংশোধনী

অ্যাসোসিয়েটস প্রেস এদিন সংবাদ পরিবেশন করে, পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন সামরিক আদালতে বিচারপদ্ধতি সংশোধন করছে। সংশোধিত পদ্ধতি অনুযায়ী সামরিক আইনের ৮৮ ধারায় বলা হয়েছে, আসামির জন্য কৌঁসুলির উপস্থিতি প্রয়োজন হবে না। সাক্ষাৎ গ্রহণের পদ্ধতিও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। আদালতের জন্য শুধু সাক্ষ্যের স্মারকলিপি প্রয়োজন হবে। আদালত যদি মনে করেন কোনো সাক্ষ্যে বিচার বিলম্বে হবে, তাহলে আদালত সেই সাক্ষ্য বাতিল করে দিতে পারবেন। নতুন আইনে আদালতের শুনানি মুলতবি রাখাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু বিচার ২৪ ঘণ্টার জন্য মুলতবি রাখা যেতে পারে।

সংবাদটি প্রচারিত হওয়ার পর পর্যবেক্ষক মহল জানায়, এতে শেখ মুজিবের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের সামরিক সরকার বিচারের ব্যাপারটি খুব গোপন রেখেছে। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, ১১ আগস্ট বিচার শুরু হওয়ার পরই তা মুলতবি রাখা হয়। শেখ মুজিব আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাননি বলেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আগের দিন চালানো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান ৩০ আগস্টও অব্যাহত থাকে। ভোরে তারা সুরকার আলতাফ মাহমুদ, কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাসহ বেশ কিছু সাধারণ মানুষকে আটক করে। দিলু রোডে হাবিবুল আলম ও রাজারবাগের আলতাফ মাহমুদের বাড়ি থেকে তারা অস্ত্র জব্দ করে। গেরিলাদের ধোলাই খাল এলাকার গোপন ঘাঁটি থেকেও কিছু অস্ত্র জব্দ করা হয়।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওহাব ও শামসুল হকের নেতৃত্বে চালনা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে আক্রমণ চালান। দিনব্যাপী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

কুমিল্লার লাকসাম থেকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল এই দিন চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। আরেকটি গেরিলা দল ঢাকার অদূরে আড়াইহাজার থানা আক্রমণ করে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সোনাপুর ও গোপালপুরের কাছেও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

মানিকগঞ্জে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তাদের হরিরামপুরের ঘাঁটি থেকে রসদ নিয়ে লঞ্চে করে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকার হতাহত এবং লঞ্চটির বেশ ক্ষতি হয়।

ঝিনাইদহে ভারত সীমান্তবর্তী আলফাপুর খালের পাড়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল বাগেরহাটের শরণখোলায় পাকিস্তান বাজারে একদল রাজাকারের ওপর আক্রমণ চালালে তিনজন আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, আট ও নয়; স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‌্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন; দ্য গার্ডিয়ান, ৩০ আগস্ট ১৯৭১; দৈনিক পাকিস্তানআজাদ, ৩১ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান