বিজ্ঞাপন
default-image

২ এপ্রিল ঢাকায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দিন বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে ঢাকার দক্ষিণে জিঞ্জিরায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে বহু মানুষ নদী পেরিয়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিল। স্থানীয় অধিবাসীসহ বাইরে থেকে আসা নিরীহ মানুষ সে গণহত্যার নির্মম শিকার হন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম আক্রমণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঠাকুরগাঁও, সুনামগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা দিয়ে হাজার হাজার মানুষ এই দিনেও সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়।

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় (বাংলাদেশ) সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন একটি নির্দেশনা জারি করে। নির্দেশনাগুলো হলো অনুপস্থিত সরকারি কর্মচারীরা অবিলম্বে কাজে যোগ দিলে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না; ভারতীয় নাগরিক কোনো অনুপ্রবেশকারীকে কেউ আশ্রয় দিলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং ঢাকার সব বাড়ি-গাড়ির নম্বর এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড উর্দুতে লিখতে হবে।

আরেকটি বিবৃতিতে (হ্যান্ড আউট) সামরিক কর্তৃপক্ষ জানায়, ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে। পাকিস্তান ভারতের কাছে তার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়।

ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এই দিন সকালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

তাজউদ্দীন আহমদের দিল্লি যাত্রা

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ দেশটির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে রাতে দিল্লি রওনা দেন। তিনি যান বিএসএফের একটি পুরোনো মালবাহী রুশ বিমানে। ঘড়ির কাঁটা তখন ১ এপ্রিল দিবাগত রাত পেরিয়ে ২ এপ্রিল। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং ভারতের বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদার তাঁর সহযাত্রী।

২ এপ্রিল সকালে তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে গিয়ে পৌঁছান।

বিদেশি তথ্যমাধ্যমের সমালোচনায় ভুট্টো

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে তাঁর দলের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি সাংবাদিকদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তারা পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে চীনের বার্তা সংস্থা এনসিএনের প্রতিনিধি ছাড়া আর কোনো বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন না। তাঁকে দেখতে পেয়ে ভুট্টো মৃদু হেসে বলেন, ‘সে তালিকায় আপনি পড়েন না।’

ভুট্টো বলেন, ভারতের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তান বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। ভারতীয় লোকসভায় গৃহীত প্রস্তাবের নিন্দা করে তিনি বলেন, উত্তেজনা বৃদ্ধি করাই এর উদ্দেশ্য।

ইয়াহিয়াকে সোভিয়েত প্রেসিডেন্টের চিঠি

সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রুশ ফেডারেশন) সুপ্রিম প্রেসিডিয়ামের সভাপতি নিকোলাই পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ২ এপ্রিল একটি চিঠি পাঠান। চিঠিটি কূটনৈতিক মাধ্যমে ৩ এপ্রিল ইয়াহিয়ার কাছে পৌঁছায়।

চিঠিতে পদগোর্নি লেখেন, সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করার খবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী রাজনৈতিক নেতাদের জুলুম ও গ্রেপ্তারের ঘটনাতেও তাঁরা উদ্বেগ বোধ করছেন।

চিঠিতে শক্তি প্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে ও শান্তিপূর্ণ পথে সমস্যার সমাধানের জন্য আহ্বান জানানো হয়।

বাংলাদেশের সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও একটি বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের মানুষের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি এবং দুর্দশায় তাঁরা উদ্বিগ্ন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, ত্রয়োদশ খণ্ড; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১, আমীর-উল ইসলাম, (কাগজ প্রকাশন); দৈনিক পাকিস্তান, ৩, ৪ ও ৬ এপ্রিল ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান