বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় হরতাল আহ্বান করেছিলেন। ২ মার্চ ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালে অচল ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। জনতা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দেয়, স্বাধিকারের প্রশ্নে কোনো আপস নেই।

সকাল থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাকার সব দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠানেই কর্মচারীরা কাজে যোগ দেননি। রেল ও বিমান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা হাতে রাজপথে নেমে আসে।

বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর আহ্বানে ছাত্র সমাবেশ হয়। বিকেলে বায়তুল মোকাররম ও পল্টনে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। সন্ধ্যায় ক্লান্ত-শ্রান্ত জনতা ঘরে ফেরে। কিন্তু সন্ধ্যার পর হঠাৎ শহরে কারফিউ জারির ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ জনতা আবার রাজপথে নেমে আসে।

সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন কারফিউ জারি করেছিল রাত নয়টা থেকে পরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত। পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়। রেডিওতে কারফিউ জারির ঘোষণা শুনে বিভিন্ন এলাকায় জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসে ব্যারিকেড দেয়। গভীর রাত পর্যন্ত কারফিউ ভেঙে মিছিল করে। মিছিলে স্লোগানের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে শোনা যায় গুলিবর্ষণের আওয়াজ। রাতে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণে শতাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরীর হাসপাতালগুলোতে বুলেটবিদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

কারফিউ জারির পর রাত পৌনে ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলেও ছাত্ররা মোটেই দমে যাননি। উল্টো আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। সারা রাত বিক্ষোভ চলতে থাকে পাড়ায় ও মহল্লায়। বিভিন্ন স্থানে টহলদার সামরিক বাহিনী মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু তাতেও মিছিল থেমে যায়নি।

মানুষ পত্রিকা অফিসগুলোয় গুলিবিদ্ধ আহত মানুষদের পৌঁছে দিতে থাকেন। ইত্তেফাক অফিসে বুলেটবিদ্ধ দুজনকে, দৈনিক পাকিস্তান কার্যালয়ে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে, মর্নিং নিউজ-এ দুজনকে, সংবাদ অফিসে দুজন, ভজহরি সাহা স্ট্রিটে ছয়জনকে আহত অবস্থায় মিছিলকারীরা রেখে যান। আহত আরও ২৫ ব্যক্তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিন আট ব্যক্তি প্রাণ হারান। (সূত্র: বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস: ১৮৩০ থেকে ১৯৭১, মোহাম্মদ হান্‌নান।)
বিকেলে মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে উপস্থিত ছাত্র-জনতা একটি রেলগাড়ি আটকে তার বগি তিন-চার জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে। মালিবাগ মোড়ের ট্রাফিক আইল্যান্ডের কাছে কয়েকজন ছাত্র ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন। এ সময় একটি সামরিক যান থেকে গুলি চালানো হয়। গুলিতে প্রাণ হারান ফারুক ইকবাল নামের একজন। তাঁকে ওই ট্রাফিক আইল্যান্ডের ওপরই সমাহিত করা হয়।

জাহানারা ইমাম তাঁর একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে এদিনের ঢাকার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘সকালে নাশতা খাওয়ার পর সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের মাঝখান দিয়ে খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম। একটাও গাড়ি, রিকশা, স্কুটার এমনকি সাইকেলও নেই আজ রাস্তায়।…হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের দিকে চলে গেলাম। কী আশ্চর্য! আজকের কাঁচাবাজারও বসেনি। চিরকাল দেখে আসছি হরতাল হলেও কাঁচাবাজারটা অন্তত বসে। আজ তাও বসেনি। শেখ মুজিবসহ সবগুলো ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে সর্বত্র যানবাহন, হাটবাজার অফিস-আদালত ও কল-কারখানায় পূর্ণ হরতাল পালনের ডাক দেওয়া হয়েছে, সবাই সেটা মনেপ্রাণে মেনে নিয়েই আজ হরতাল করেছে।’

প্রতিদিন হরতাল: রাতে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে ঢাকায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের কঠোর নিন্দা করেন। এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তিনি ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বাংলাদেশে হরতালের আহ্বান জানান। ৩ মার্চ জাতীয় শোক দিবস পালনের ডাক দেন।

বঙ্গবন্ধু জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, এই সংকটের সন্ধিক্ষণে সরকারি কর্মচারীসহ সর্বস্তরের প্রত্যেক বাঙালির পবিত্র কর্তব্য হচ্ছে গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে অসহযোগিতা করা এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশগুলো হলো:
১. ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন।
২. ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সেই দিনকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন।
৩. রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে বাঙালি জনতার কর্মতৎপরতার বিবরণী বা বিবৃতি প্রকাশ করতে দেওয়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাঙালি কর্মচারীদের বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের চেষ্টা নাকচ করে দেওয়া।
৪. ৭ মার্চ বেলা দুইটায় রেসকোর্স ময়দানে গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা।
৫. সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংগ্রাম চালানোর আহ্বান।

মানচিত্রখচিত পতাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ছাত্র সমাবেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হঠকারী ঘোষণার প্রতি ধিক্কার জানানো হয়। সেখানে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল, সবুজ, সোনালি—এই তিন রঙের পতাকা। তখন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সেখানে উত্তোলিত পতাকাই কার্যত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপ লাভ করে।

প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও এই পতাকাকেই জাতীয় পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেছিল। (সূত্র: পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ, নূরে আলম সিদ্দিকী)
করাচিতে ভুট্টোর সংবাদ সম্মেলন: করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। দেশের দুটি প্রধান দল শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছানোমাত্রই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে কোনো বাধা থাকবে না। অধিবেশন স্থগিত রাখায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একসঙ্গে আলোচনায় বসে সমঝোতায় পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছে। তিনি বলেন, সত্যিকার ফেডারেশনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পরিষদ গঠিত হওয়া উচিত। তারা আপসহীন কোনো অবস্থান নেয়নি।

ভারত সরকারের দুঃখ প্রকাশ: পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ বেতার বিবৃতিতে জাতীয় পরিষদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত রাখার অন্যতম কারণ হিসেবে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনাকর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করায় দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ মন্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন।


সূত্র: ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান, আজাদ ও মর্নিং নিউজ, ৩ মার্চ ১৯৭১
গ্রন্থনা:
রাশেদুর রহমান