বিজ্ঞাপন
default-image

ভারত সফররত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের উপহাইকমিশনার চার্লস মেস ৯ মে বলেন, বাংলাদেশে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বিপুলসংখ্যক মানুষ সেখান থেকে পালিয়ে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন। জাতিসংঘ বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের যথাসাধ্য সাহায্য দেওয়ার চেষ্টা করবে। তাঁর বিশ্বাস, সারা বিশ্বও শরণার্থীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।

জাতিসংঘ মিশনের ভারতে আসতে এত দেরি হলো কেন, এ প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য বলেন, জাতিসংঘের শরণার্থী মিশন আদৌ আসবে কি না, তা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ১০ দিন আগে শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ভারতে মিশন পাঠানোর কথা তাঁদের জানান। এরপর তাঁরা ভারতে এসেছেন।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে এদিন বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষার দাবিতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে শতাধিক মানুষ অংশ নেন। সদ্য পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করা বাঙালি কূটনীতিক এ এইচ মাহমুদ আলীও তাঁদের মধ্যে ছিলেন।

আমেরিকার বাংলাদেশ লীগের সভাপতি কাজী এম আহমদ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশকে সমর্থনের অনুরোধ জানান।

ব্রিটেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এদিন অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে সকালে ব্রাডফোর্ডে ও বিকেলে বার্মিংহামে সভা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি সভায় বক্তব্য দেন বহির্বিশ্বে ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

ভারতের রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান পদ্মজা নাইডু বিশ্ব রেডক্রস দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক ভাষণে আশা প্রকাশ করেন, ভারতে অবস্থানরত জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল তাদের পর্যবেক্ষণকাজের জন্য আর বেশি সময় ব্যয় করবে না। ভারতীয় রেডক্রস শরণার্থী ত্রাণের ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগেই সাহায্য করছে। কিন্তু এই বিরাট কাজে অন্য দেশকেও দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

ভারতের কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়নমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী এদিন ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তি ও জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ভারত নৈতিক দিক থেকে বাধ্য।

ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকার আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, বাংলাদেশি শরণার্থীদের সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সাহায্য কেন্দ্র থেকে তাদের দেওয়া হবে।

সামরিক কর্তৃত্বের পাকিস্তানে

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি এই দিন সিলেট অঞ্চলে সেনাবাহিনীর অবস্থানগুলো পরিদর্শন করেন। এ সময়ে স্থানীয় কমান্ডার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অভিযান সম্পর্কে তাঁকে জানান। নিয়াজি সিলেটের ২২ কিলোমিটার উত্তরে হেমু সীমান্ত পরিদর্শনে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র তাঁকে দেখানো হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঞ্চগড়ের অমরখানার জগদল এলাকায় দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করে। এর খুব কাছেই ভারতের সীমান্ত এলাকা। যুদ্ধের প্রথম ভাগে মুক্তিযোদ্ধারা অমরখানা ধরে রাখলেও পরবর্তী সময়ে সেখানে টিকে থাকতে পারেননি। অমরখানা দখল করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। সেখানে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, বহু সৈন্য সমাবেশ, দুর্ভেদ্য বাংকার নির্মাণ, পিলবক্স, ট্রেঞ্চ ও অবজারভার পোস্ট স্থাপনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করে।

একটি পাকিস্তানি সেনাদল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ৩৬০ জন মানুষের ওপর লোমহর্ষ হত্যাকাণ্ড চালায়। গজারিয়ার গোশাইরচর, নয়ানগর, কাজীপুরা, বাঁশগাঁও ও বালুরচরের মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি, ভোরের আলোয় তাদের জন্য কী বিভীষিকা অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানি সেনারা যাকে যে অবস্থায় পায়, সেভাবেই গুলি করে হত্যা করে। আগুন দিয়ে বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেয়।

ঢাকার নবাবগঞ্জের বর্ধনপাড়া ও কলাকোপায় পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।

নাটোরের কলম ও হাতিয়ান্দহে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদিন ২০ জনকে হত্যা করে।

মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা

কুমিল্লার কটকবাজারে পাকিস্তানি সেনার একটি দলকে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করে। তীব্র যুদ্ধ হয় বগাদিয়ায়। অবশেষে একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে।

কক্সবাজারে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করতে সক্ষম হন।

কোটালীপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হেমায়েত উদ্দিনের (পরে বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে যায়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় হরতকীডাঙ্গা গ্রামের কাছে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গতিরোধ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদলের কাছ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও সাত; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; পূর্বদেশ, ১০ মে ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১০ মে ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান