বিজ্ঞাপন
default-image

যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা ১ ডিসেম্বর জানায়, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্য পাকিস্তানের অনুরোধটি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদে বিতর্কের জন্য পাঠিয়েছেন। রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হয়, উ থান্টের অনুরোধে তাঁর কাছে লেখা ইয়াহিয়ার চিঠির অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে।

নিউইয়র্কে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিরোধিতা করবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, এটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের রক্ষা করার অপপ্রয়াস। কারণ, ইয়াহিয়া খান যখন সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন সবাই নীরব দর্শক হয়ে ছিল।

রাজনৈতিক মীমাংসা তিরোহিত

ভারত সরকারের একটি সূত্র জানায়, ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা নিক্সনের চিঠির কারণে রাজনৈতিক মীমাংসার অবশিষ্ট সুযোগ শেষ। কারণ, চিঠিটি ইসলামাবাদের একগুঁয়ে মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আবার সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য ইয়াহিয়ার প্রস্তাবটিকে দিল্লির রাজনৈতিক মহল বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘকে জড়ানোর কৌশল বলে ভাবছেন। এর পেছনে তারা ওয়াশিংটনের হাত আছে বলে মনে করছে।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কার্যনির্বাহক কমিটির বৈঠকে বলেন, মুক্তিবাহিনী যশোরের দোরগোড়ায়। যশোরের পতন হলে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়তিনির্ধারক পথে মোড় নেবে।

মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রা

মুক্তিবাহিনী ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তসংলগ্ন শমশেরনগর শহর ও তৎসংলগ্ন বিমানঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিতে উপর্যুপরি আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনী রংপুরের কুড়িগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি নাগেশ্বরীর দখল নিয়ে নেয়। এরপর তাঁরা ধরলা নদী পার হয়ে কুড়িগ্রাম দখলের জন্য লড়াই চালাতে থাকে। পঞ্চগড়ের বোদায় তুমুল যুদ্ধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে।

খুলনার কালীগঞ্জ মুক্ত

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, সাংসদ ফণীভূষণ মজুমদার, তোফায়েল আহমেদসহ বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব কে এ জামান ও পুলিশের আইজি আবদুল খালেক এদিন মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরে গেরিলা অভিযান পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলারা পাকিস্তান পিপলস পার্টির ঢাকা অফিসে বিস্ফোরণ ঘটান।
শান্তিবাগে গেরিলাদের অভিযানে মুসলিম লীগের দুজন নেতা নিহত এবং দুজন আহত হয়।

বিদেশি গণমাধ্যমের মন্তব্য

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান-এর এক সংবাদে এদিন বলা হয়, ১৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল প্রায় ১০০ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরও জাতিসংঘের ১৩১ সদস্যদেশের একটিও এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ঢাকা হাইকোর্টের প্রবীণ বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন আরও একজন উপাচার্য, আওয়ামী লীগের আটজন জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং দুজন রাষ্ট্রদূত।
দ্য টাইমস ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ এক খবরে বলে, ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়োজন পূর্ণ স্বাধীনতা। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী ভারত সরকারের এ মনোভাব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেন।

যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী রিচার্ড উড লন্ডনে বলেন, তাঁর ধারণা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। তবে তারা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়।

সংবাদ সংস্থা এবিসির হংকং ব্যুরোর প্রধান বাংলাদেশ থেকে এক প্রতিবেদনে জানান, কয়েক দিন আগে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা শহরের কাছে এক গ্রামে নির্বিচার প্রায় ৭৫ জন নরনারীকে হত্যা করে। কারণ, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তিনি নিজেও পরে ঘটনাটি দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন।

নিউইয়র্ক টাইমস-এ এদিন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও তার কাছাকাছি অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা যত্রতত্র গ্রামবাসীদের হত্যা করছে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জিনজিরার লোকেরা সংবাদদাতাকে জানান, ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা সন্ধ্যা থেকে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৮৭ জনকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানান, আগুনের শিখায় ঢাকার দিগন্ত রক্তিম। বুড়িগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে অগণিত মৃতদেহ।

সূত্র: স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‌্যাডিক্যাল পাবলিকেশন্স, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২ ও ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য গার্ডিয়ান, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ২ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য টাইমস ও দ্য টেলিগ্রাফ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১ ডিসেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান