বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাসংক্রান্ত জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে ১৮ নভেম্বর সারা দিন বিতর্কের পর নেদারল্যান্ডস ও তিউনিসিয়া ভারত উপমহাদেশে ওই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আলাদা দুটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করে। পাকিস্তানের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়নি, এমন প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি নেদারল্যান্ডসের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
তিউনিসিয়ার প্রস্তাবে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমঝোতার জন্য বিবদমান দুই পক্ষের কাছে আবেদন জানাতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতিকে অনুরোধ জানানো হয়।
ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে এই দিন বলা হয়, বিদেশি নেতাদের মধ্যে অনেকেই ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন, শেখ মুজিবের মুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু ইয়াহিয়ার আশঙ্কা, তাঁকে মুক্তি দিলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউস কমন্স সভার অধিবেশনে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ এড়াতে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে কমনওয়েলথের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেজিল্যান্ড মডলিং বলেন, যুক্তরাজ্য তা-ই করছে।
পাকিস্তানে চীনা প্রতিনিধিদল
চীন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী লি সুই চিংয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ৮ দিনের সফরে ১৮ নভেম্বর ইসলামাবাদে পৌঁছায়। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গেও আলোচনা করবেন।
রাওয়ালপিন্ডির এক সংবাদপত্র জানায়, পাকিস্তানে বসবাসরত প্রায় ১ হাজার ৪০০ নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরিকল্পনা করেছে। একজন বিদেশি কূটনীতিক বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো অসম্ভব। জরুরি নয়, এমন কূটনীতিক এবং তাঁদের পরিবারদের অপসারণ করা হচ্ছে।
উ থান্টকে ইন্দিরার চিঠি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক চিঠিতে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে বলেন, সেখানকার জনসাধারণের ইচ্ছার সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি কোনো রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করলে সেটিকে স্বাগত জানানো হবে। জাতিসংঘের মহাসচিবের ২০ অক্টোবরের চিঠির জবাবে ১৬ নভেম্বর তিনি এ চিঠি লেখেন। লোকসভার এ দিনের অধিবেশনে চিঠিটি পেশ করা হয়।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি রাতে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে বলেন, যেকোনো আক্রমণ মোকাবিলা করতে ভারত সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে জানান, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে না।
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাজ্য মনে করে, বাংলাদেশ সমস্যার দায় পাকিস্তানের এবং এর রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত।
মুম্বাইয়ে পাকিস্তানি সহকারী হাইকমিশনের প্রবীণ বাঙালি কর্মী শাহজালাল মিয়া পালিয়ে এসে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এসে পুলিশের কাছে আশ্রয় চান।
বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সঙ্গে প্রায় ৬ ঘণ্টা বৈঠক করেন। তাঁর সঙ্গে একজন ভারতীয় কর্মকর্তাও ছিলেন। দিল্লি থেকে কলকাতায় পৌঁছে তাঁরা সোজা মুজিবনগরে যান। তাঁদের বৈঠকের বিষয় প্রকাশ করা হয়নি।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কর্ণফুলী টি এস্টেটে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিলোনিয়া অঞ্চলে মুন্সিরহাট ও পরশুরাম পাকিস্তানি দখল মুক্ত করার পর এ দিন ফুলগাজীর বিরাট এলাকা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানিরা ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফেনীর কাছে পিছু হটে।
এই সেক্টরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি মুক্তিযোদ্ধা দল কাইয়ুমপুরে পাকিস্তানি সেনা-অবস্থানে দুটি বাংকার ধ্বংস করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
সিলেটের গোয়াইনঘাট সংলগ্ন রাধানগর এলাকার ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়।
৭ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের (১৪ ডিসেম্বর শহীদ এবং স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ) তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন একটি আমবাগানে পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ শেষে ঘাঁটি দখল করার পর হঠাৎ পেছনের বাংকারে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনারা গুলি করতে থাকে। এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পাকিস্তানিরা আবার ঘাঁটি দখল করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা জীবননগরের দত্তনগর কৃষি খামার পাকিস্তানি বাহিনীর দখল মুক্ত করেন। ১৭ নভেম্বর রাত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল তিন দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। তাঁদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা টিকতে না পেরে সকালে পিছু হটে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, সাত ও আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৯ ও ২০ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৮ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য টাইমস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৮ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান