জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ১৯ সেপ্টেম্বর বলেন, মানবিক নীতির প্রতি মর্যাদা রেখে আপসের ভিত্তিতে একমাত্র রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মূল সমস্যার সমাধান সম্ভব। সমস্যার জটিলতা এখানেই যে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার প্রয়াসের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির অভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকারের উদ্যম বিঘ্নিত হচ্ছে এবং ওই অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনের ওপর এর প্রভাব পড়ছে।
উ থান্ট আরও বলেন, বাংলাদেশের সংঘর্ষ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও এর ফলে এমন সব সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর জন্যও উদ্বেগের ব্যাপার। বিশ্বের সমস্যাগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে তিনি বিশ্ববাসীকে সক্রিয় হতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ওই দেশের সরকার ও জনগণকে সব রকমের সাহায্য করা বিশ্ববাসীর কর্তব্য। জাতিসংঘের কাজকর্মের ওপর মহাসচিবের রিপোর্ট দিতে গিয়ে উ থান্ট এই কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাচ্ছেন না, সেটা তিনি লক্ষ করেছেন।
বাংলাদেশের সীমান্ত পার হবেন ২৫ দেশের প্রতিনিধিরা
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সমবেত ২৫টি দেশের প্রতিনিধিরা এই দিন প্রস্তাব দেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি জনগণের স্বীকৃতি প্রদর্শনের জন্য তাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে যাবেন। বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের মানবসমাজের দায়িত্ব সম্পর্কে গঠিত কমিশনের প্রতিনিধিরা সারা দিন আলোচনার পর তাঁদের প্রতিবেদনে কাবুল থেকে রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত পদযাত্রার আহ্বান জানান। সিংহলের প্রতিনিধি স্যার সেনার্থ গুনবর্ধনে এ কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। প্রতিনিধিরা আরও সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তানি বর্বরতার শিকার বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ–দুর্দশা নিজেদের চোখে দেখার জন্য শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করবেন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্রতিনিধিরা তিনটি কমিশনে ভাগ হয়ে তিনটি বিষয় পরীক্ষা করে দেখেন। খসড়া কমিটি তিনটি কমিশনের সুপারিশ ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে প্রকাশ্য অধিবেশনে পেশ করবেন। পরে একটি সুসংহত প্রস্তাব নেওয়ার জন্য অধিবেশনে কমিশনের সুপারিশগুলো একত্র করা হবে। ডেনমার্কের নিয়েলসনের নেতৃত্বে একটি কমিশন বাংলাদেশের ব্যাপার নিয়ে কাজ করে। এর সংযোগকারী ছিলেন ডা. জয় শেখর। দ্বিতীয় কমিশন কাজ করে মুক্তি আন্দোলন এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সমর্থনের প্রশ্নটি নিয়ে। এর নেতৃত্বে ছিলেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সাংসদ উইলিয়াম মুলয়। সংযোগকারী ছিলেন ডা. মহম্মদ আইয়ুব। তৃতীয় কমিশনের নেতা সিংহলের স্যার সেনার্থ গুনবর্ধনের সংযোগকারী ছিলেন কে পি করুণা করণ।
সম্মেলনে যোগদানকারী সব দেশের প্রায় ৪৫ জন প্রতিনিধির অধিকাংশই কোনো না কোনো কমিশনে অংশ নেন। সম্মেলনের সঙ্গে ভারত সরকার জড়িত না থাকলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যোগদানকারী বিশিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগ করেন।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন এদিন ঘোষণা করে, চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বরের পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৭৮টি শূন্য আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১০৫টি শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের দলনেতা এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি মাহমুদ আলী ১৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের উদ্দেশে লন্ডন যাত্রার আগে করাচিতে বলেন, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা লক্ষ্মীপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে রকেট লঞ্চারের সাহায্যে হামলা করলে কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি অবস্থানে একযোগে আক্রমণ চালান। আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মালোচিন বাজারে পাকিস্তানি অনুগত পুলিশের একটি দলকে আক্রমণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পঞ্চগড়ের অমরখানায় পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল যশোরের শার্শার বোয়ালিয়া বাজারের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে। চার দিন ধরে চলা এই যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকজন সাধারণ নাগরিক শহীদ এবং অনেকে আহত হন। একই সেক্টরের গোজাডাঙা সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের মোহাম্মদপুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালান। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন হতাহত হয়।
ময়মনসিংহের ভালুকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দুই ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১, ২, ৬ ও ৮; পূর্বদেশ, ঢাকা, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান