বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৩ নভেম্বর সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পাকিস্তান আক্রমণের শিকার হতে পারে, এ আশঙ্কায় ইয়াহিয়া খান দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশই সীমান্তে প্রচুর সেনা সমাবেশ করায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন।

এর আগে ১২ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে। এর পরই তাঁর নিদে৴শে পশ্চিম সীমান্তে বিপুল সেনার সমাবেশ করা হয়। পূর্ববঙ্গ সীমান্তেও সেনাসমাবেশ করা হয়েছে। সীমান্ত থেকে ভারতের ভেতরে ক্রমাগত গোলাবর্ষণ চলছে।

ভারত সরকার খবর পেয়েছে, পাকিস্তান বিমানবাহিনী আচমকা তাদের আকাশসীমায় হানা দিতে পারে। এসব তৎপরতার প্রেক্ষাপটে ভারতও সীমান্তে সেনাসমাবেশ করেছে।

ইয়াহিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিকও রাওয়ালপিন্ডির পথে করাচিতে আসেন।

সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ইন্দিরার আলোচনা

পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত তাঁর শীর্ষস্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শে বসেন। পাকিস্তান একদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে তাদের সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। ভারতে অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পর উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা এসবের প্রেক্ষাপটে সবার সঙ্গে আলোচনা করেন।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো দুঃসাহস দেখালে এবার ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হবে পাকিস্তানের। এবার যুদ্ধ হলে পাকিস্তানের মাটিতেই হবে এবং তার ফয়সালাও হয়ে যাবে।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন

যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বিবিসি এই দিন জানায়, ঢাকায় সবার ধারণা ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। সাংবাদিকদের যশোরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে যুদ্ধ চলছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা নিতে চাইলে শেখ মুজিবসহ পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়েছে, বিশ্ব সংস্থার উচিত সেটিকে সমর্থন করা।

যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস–এর সংবাদদাতার রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাঠানো খবরে এক সামরিক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, যশোর ও সিলেটের ছোট ছোট এলাকা ভারতীয় সেনারা দখল করে নিয়েছেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতার খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিবৃতি উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এটি তাঁদের জীবনমরণ যুদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের একটি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ভারত থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। সিনেট ও কংগ্রেসের কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য সে পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, প্রতিনিধি সভা যে সংশোধন অনুমোদন করেছে, এই প্রস্তাবে তা লঙ্ঘন করা হয়েছে।

তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণ

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন বেতার ভাষণে বলেন, নানা দিক থেকে সাফল্য এসেছে। স্বাধীনতা লাভের দিন নিকটতর হয়েছে। মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়টিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানান।

২ নম্বর সেক্টরে কসবার চন্দ্রপুরের যুদ্ধে শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধারে একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী আবার আক্রমণ করলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

এই সেক্টরে মন্দভাগ অবস্থান পুনর্দখল করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী জায়গাটির কাছে একত্র হলে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন হতাহত হন। এখানে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি সেনারা সালদা নদীর সন্নিকটে একটি রেলসেতুর কাছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে হামলা চালায়। তারা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর একটি বাংকার ধ্বংস করে। মুক্তিবাহিনী প্রবল পরাক্রমে প্রতিরোধ করলে শেষ পর্যন্ত তারা বুড়িচং ও কুমিল্লার দিকে সরে যায়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ হন এবং চারজন আহত হন।

মুক্তিবাহিনীর নৌযোদ্ধারা চালনা বন্দরের মুখে মাইন দিয়ে ‘এসএস রাইজোভেলান্ডু’ নামের একটি মালবাহী গ্রিক জাহাজ ডুবিয়ে দেন। এতে চালনা বন্দরে জাহাজ ঢোকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

সূত্র: স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‌্যাডিক্যাল পাবলিকেশন্স, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৪ ও ২৫ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য টাইমস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ২৪ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, যুক্তরাষ্ট্র, ২৩ নভেম্বর, ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান