১ নম্বর সেক্টরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা ৬ অক্টোবর এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ধ্বংস করেন। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটির অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের উত্তরে, হালদা নদীর পশ্চিম পাশে। সেখানে ছিল তিনটি বড় আকারের ট্রান্সফরমার। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এটির মাধ্যমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে এর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া প্রায় ১০০ জনের একটি দল।
মুক্তিযোদ্ধারা আগেই রেকি শেষ করে লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও বিমানবাহিনীর প্রধান) নেতৃত্বে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে এ দিন রাতে উপকেন্দ্রটির কাছে অবস্থান নেন। পরিকল্পনামতো মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি উপদল গোলাগুলি করে উপকেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যস্ত রাখে।
এই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল উপকেন্দ্রের ট্রান্সফরমারের কাছে অবস্থান নিয়ে সেটিকে লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করে। এতে ট্রান্সফরমারে আগুন ধরে যায় এবং তিনটি ট্রান্সফরমারই ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। অভিযান শেষে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। একটি গুলি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের পেটে লাগে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বেস ক্যাম্পে রওনা হন। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই অভিযানের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার এবং খবরের কাগজে ব্যাপক প্রচারিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য এটি ছিল একটি বড় ঘটনা।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা দলের দুজন গেরিলা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আরেকটি দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। ফেনীর সীমান্তরেখার কাছে তাঁরা দেখতে পান, পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি গাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রশস্ত্র নামাচ্ছে। তাঁরা তখন হামাগুড়ি দিয়ে কাছাকাছি গিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে গাড়ি দুটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। একজন পাকিস্তানি সেনাও আহত হয়।
এই সেক্টরের ফেনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কয়েকটি ছোট দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে গিয়ে করিমগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। গেরিলাদের একটি দল বেলা আনুমানিক তিনটায় ফেনীর ছাগলনাইয়া এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুহুরীগঞ্জের মধ্যবর্তী স্থানের রেলসেতুটি উড়িয়ে দেয়। আরেকটি দল করিমগঞ্জ হাইস্কুলের কাছে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করে।
ফেনী অঞ্চলের অন্য একটি গেরিলা দল ছাগলনাইয়া সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে। দলটি ক্রলিং করে আগের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছাকাছি গিয়ে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সকালে পাকিস্তানি সেনারা কোনো সতর্কতা ছাড়াই বাংকার খননের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে তাদের আক্রমণ শুরু করেন। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল ছাগলনাইয়ার রাধানগরে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের ঘাঁটি তহশিল অফিস পুড়িয়ে দেয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনীর ছাগলনাইয়ার মহামায়ার কাছে পূর্বদেবপুরের সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আগের দিনের মতো আবার অ্যামবুশ করেন। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা গোপীনাথপুর, চান্দিনা, সালদা নদী ও নয়নপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এ ছাড়া রাতে দুর্লভপুরের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের রাজশাহী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ঘোষপুর গ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা করলে কয়েকজন হতাহত হয়।
পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের নিন্দা
যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এ দিন তাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীশিবিরগুলোকে পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষ বলে উল্লেখ করে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীকে এর জন্য দায়ী করে। নিবন্ধে বাংলাদেশ সংকটের সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পৃথিবীর সব সরকারের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়ার সামরিক প্রশাসনকে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। তারা সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার নিন্দা করে।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানে নিয়োজিত চীনের কনসাল জেনারেল সিয়াও চুইজই করাচিতে চীনের বিপ্লব দিবস উপলক্ষে পাকিস্তান-চীন মৈত্রী সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেন, চীন পাকিস্তানের স্বাধীনতা রক্ষা এবং পাকিস্তানে বিদেশি হামলা ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সব সময় দৃঢ় সমর্থন জানাবে।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান আবদুর রহিম খান সম্ভাব্য পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ নিয়ে এ দিন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে আলোচনা করেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এ দিন পাকিস্তানের অনুগত প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খানের সঙ্গে দেখা করে। তিনি জমিয়ত নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করার এবং দেশ পুনর্গঠনের আহ্বান জানান।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও সাত; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৭ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ৭ ও ৮ অক্টোবর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান