বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের নিয়ে গঠিত সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ৮ এপ্রিল এক দীর্ঘ বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ইয়াহিয়া ও তাঁর বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা, স্বাধিকারবোধ ও মানবিক মর্যাদাকে যখন ট্যাংকের চাকায় পিষে ফেলতে চাইছে, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা এ অবস্থায় নীরব বা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না।

বিবৃতিতে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতসহ পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনাসম্পন্ন সবাই বাংলাদেশের সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিক এবং সব রকমের সাহায্য নিয়ে পাশে দাঁড়াক। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তারা সামর্থ্যের চেয়ে বেশি সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এই দিনে কলকাতায় অধ্যাপকেরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলের আগে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কয়ারে অধ্যাপকদের প্রতিবাদ সভা হয়। সভার পর অধ্যাপকদের মিছিল বিভিন্ন পথ ঘুরে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন এবং পরে বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) দূতাবাসের সামনে যায়। মিছিল থেকে দূতাবাসে দুটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়।

বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতিও বাংলাদেশকে সাহায্য করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করে।

বাংলাদেশ থেকে ভারতের ত্রিপুরায় যাওয়া শরণার্থীদের জন্য ৮ এপ্রিল রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নয়টি শিবির খোলা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ওয়াল্টার এফ মন্ডেল এক চিঠিতে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সাহায্য কর্মসূচি আবার পর্যালোচনার জন্য নিজ দেশের সরকারের প্রতি দাবি জানান।

কালুরঘাটের কৃষি ভবনে যুদ্ধ

মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীরে কালুরঘাটে কৃষি ভবনে অবস্থান নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি প্লাটুন। ফলে কালুরঘাটের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওই এলাকায় অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা ও ইপিআরের বাঙালি সেনাদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক মেজর মীর শওকত আলী (পরে বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী) পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন মুক্তিবাহিনীকে। তাঁর নির্দেশে লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী (পরে বীর বিক্রম, রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্রসচিব) কিছু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করেন।

তুমুল সে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হতে পারেননি। যুদ্ধে নায়েক আলী নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিজেদের অবস্থানে চলে যান।

পাকিস্তানের তৎপরতা

জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে ৮ এপ্রিল একটি নোট পাঠান। নোটে তিনি অভিযোগ করেন,পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদ দিচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন জানায়, দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিবাহিনী) পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে যানবাহন চলাচলে অন্তরায় সৃষ্টির জন্য রাস্তায় যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, বিমানবাহিনী সেসব ধ্বংস করছে। বিমানবাহিনী সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের আস্তানা ও যানবাহনের ওপর আঘাত হানছে।

ঢাকায় কিছু বাঙালি রাজনৈতিক নেতা এই দিনও আলাদা আলাদা বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রতি তাঁদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ এস এম সোলায়মান, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি শামসুল হুদা, প্রাদেশিক ইত্তেহাদুল উলেমার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মিয়া মফিজুল হক, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার এ টি এম আবদুল মতিন এবং ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মাওলানা নুরুজ্জামান।


সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১; দৈনিক পাকিস্তান, ৯ এপ্রিল ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান