বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব করেন, কলকাতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে তাঁরা জানিয়ে রাখতে চান যে ইয়াহিয়া তাঁর সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করতে রাজি। ফারল্যান্ডের এ প্রস্তাবে ইয়াহিয়াও রাজি হন।

যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে মোশতাকের এই গোপন যোগাযোগের খবর তখনই প্রকাশ পায়। এ ব্যাপারে মূলধারা ’৭১-এর লেখক মঈদুল হাসান লিখেছেন: ‘কিসিঞ্জারের স্মৃতিকথা প্রকাশের আগে অবধি এই ঘটনার কথা অবিদিত থাকলেও এই ধরনের কর্মকাণ্ড যে ভিতরে ভিতরে চলছিল, তা সেই সময়ের আর একটি সূত্র থেকে প্রকাশ পায়।’

পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্টের সচিবালয় থেকে ৪ সেপ্টেম্বর এক ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়, দেশে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। ১ মার্চ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যাঁরা অপরাধ করেছেন বা যাঁদের প্রতি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে এই ক্ষমা কার্যকর হবে এবং এটি সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ, মুজাহিদ ও আনসারসহ সবার প্রতি প্রযোজ্য হবে।

আবার বাংলাদেশে যাবে অপারেশন ওমেগা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় ৪ সেপ্টেম্বর অপারেশন ওমেগা দলের মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, ৫ সেপ্টেম্বর আবার তাঁদের চারজন স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশে যাবেন। ভারতের পেট্রাপোল সীমান্ত অতিক্রম করে যশোর রোড ধরে তাঁরা হেঁটে এগিয়ে যাবেন। তাঁদের সঙ্গে কিছু খাদ্যসামগ্রী থাকবে। তাঁদের উদ্দেশ্য পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ অমান্য করে দুর্গত মানুষের সেবা করা। এর আগে ১৭ আগস্ট এই দলের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক সীমান্ত অতিক্রম করে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ভেতরে গেলে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের এক দিন আটক রেখে আবার ভারতে ফেরত পাঠায়।

default-image

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বকেয়াসহ মাসিক ভাতার একটি চেক এ দিন কবি-পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন। পাকিস্তান সরকার কবির মাসিক ভাতা মার্চ থেকে বন্ধ করে দিয়েছে জানার পর বাংলাদেশ সরকার কবিকে প্রতি মাসে ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কবির বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে বকেয়াসহ আগস্ট পর্যন্ত ভাতা পরিশোধ করা হয়।

বিদেশি পত্রিকায় বাংলাদেশ

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এ দিন তাদের সংবাদদাতা মার্টিন উলাকটের পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে খবর প্রকাশ করে, খন্দকার মোশতাক আহমদ বলেছেন, শিগগিরই ঐক্যবদ্ধ মুক্তি ফ্রন্ট গঠিত হতে চলেছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন পাওয়া সম্ভব হতে পারে।

ব্রিটেনের মর্নিং স্টার পত্রিকায় আরেকটি খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ আন্দোলনকে সাহায্য ও সমর্থন দেওয়ার লক্ষ্যে ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ শহরে একটি সলিডারিটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রমিক দল, ওয়েলস জাতীয়তাবাদী দল, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইড এবং ইয়াং কনজারভেটিভদের প্রতিনিধি রয়েছেন। কমিটি গঠনের সভায় কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ, অবিলম্বে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের মুক্তিদান এবং পাকিস্তানে অস্ত্র চালান নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত দূত সুলতান মোহাম্মদ খান সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য এ দিন মস্কো যান। পাকিস্তানে সরকারিভাবে বলা হয়, মস্কোর আমন্ত্রণেই তিনি সেখানে গেছেন, তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এমন বলা হয়নি।

গেরিলা অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এই দিন পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের চালনা ও শীতলা অবস্থানের ওপর দুই দিক থেকে আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালান। পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দখল করতে না পেরে নিজেদের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সময় কিছু বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।

৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরীতে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে ঝটিকা আক্রমণ চালালে কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা তিস্তা নদীসংলগ্ন শঠিবাড়ি বন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে দিনব্যাপী যুদ্ধ করেন। আগের দিন থেকে চলা এই যুদ্ধ সকাল থেকে তীব্র আকার নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে শঠিবাড়ি স্কুলের ভেতরে পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকারে আক্রমণ করেন। যুদ্ধ সারা রাত অব্যাহত থাকে।

৭ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধারা বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির ফুলবাড়ী ঘাটে পাকিস্তানি অনুগত ছয়জন পুলিশের ওপর আক্রমণ চালান। এতে দুজন পুলিশ নিহত এবং বাকি চারজন পালাতে গিয়ে জনসাধারণের হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়।

৮ নম্বর সেক্টরের অন্য আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মেহেরপুরের ইছাখালী সীমান্ত ঘাঁটিতে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে আক্রমণ করেন। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, ছয়, সাত ও আট; মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, ইউপিএল, ঢাকা; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি, যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা; পূর্বদেশ, ঢাকা, ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান