মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র ৬ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের জানায়, কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলীর পদবি বদলে হাইকমিশনার এবং মিশনের নাম বদলে করা হয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সেলের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডি পি ধর সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর মিশনপ্রধানের পদবি ও মিশনের নাম বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সূত্রটি আরও জানায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার
জন্য মুজিবনগরে আসবেন। তাঁর হঠাৎ আসার বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মহলটি জানায়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকার যাতে তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে পারে, সে জন্য তাদের কোনো দেশের স্বীকৃতি প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার আশা করছিল, ভারত সরকার সবার আগে তাদের স্বীকৃতি দেবে। সরকার আরও একটি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছিল, তা হচ্ছে কমনওয়েলথভুক্ত হওয়া।
অপারেশন ওমেগা দলের যে চারজন স্বেচ্ছাসেবক ৫ সেপ্টেম্বর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, তাঁরা ফিরে আসেননি।
ভারত সম্পূর্ণ প্রস্তুত: ইন্দিরা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভারত যেকোনো আক্রমণ মোকাবিলা করতে এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা কোনো দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিলে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি তার বিরুদ্ধে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তারা (পাকিস্তান) তখন এ ধরনের চিন্তাধারা থেকে হয়তো নিবৃত্ত হবে। জম্মু থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী রাজৌরিতে এক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
আইএনটিইউসির কার্যনির্বাহক কমিটি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানায়। দিল্লিতে এদিন আইএনটিইউসির দুই দিনব্যাপী বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়।
প্রবাসে আবু সাঈদ চৌধুরীর জনসংযোগ
নরওয়ে সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিন সকালে অসলোতে এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য, বর্তমান পরিস্থিতি এবং সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। সন্ধ্যায় তিনি অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে এক ছাত্র সমাবেশে বক্তব্য দেন। নরওয়ের একজন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাত্রদের সংগঠন পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করে। ব্যঙ্গচিত্রটিতে ইয়াহিয়া খানকে নরহত্যাকারী দৈত্যরূপে দেখানো হয়।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত দূত সুলতান মহম্মদ খান এই দিন মস্কোতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুলতান মহম্মদ খান সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদায় বলা হয়, পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রদর্শন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন ৪৮ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।
এক নম্বর সেক্টরের অধীন একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামে পোলো গ্রাউন্ডের প্রবেশমুখে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালালে দু-তিনজন হতাহত হয়।
ফেনীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের সিলোনিয়া নদী অতিক্রমের সময় আক্রমণ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।
শরীয়তপুর জেলায় ২০ জনের একটি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা দল পালং থানার রাজগঞ্জের কাছে নদীর পারে অ্যামবুশ পাতে। পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চে মাদারীপুরে যাওয়ার পথে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়লে গেরিলারা আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের ৩০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল মোগলহাট রেললাইনের ওপর অ্যান্টি–ট্যাংক মাইন, গ্যালাটিন ও পিইকে বসিয়ে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহী একটি ট্রেন অগ্রসর হলে মাইন বিস্ফোরণে ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে পাকিস্তানি সেনারা মক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের দুজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।
৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রেমতলী অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১, ২, ৬ ও ৭; স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকসেন্স, লন্ডন; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান