বিজ্ঞাপন
default-image

মুজিবনগরে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনের বৈঠক শেষে ২২ অক্টোবর এক প্রস্তাবে বলা হয়, সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। এই প্রস্তাবে পৃথিবীর সব মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সব দেশ ও জাতিসংঘকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সক্রিয় হতেও অনুরোধ জানানো হয়।

শরণার্থীদের ব্যাপারে এক প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগ সব শরণার্থীকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় ভারতের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা হয়, এতে বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে যথাযথ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।

কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনব্যাপী সভা ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মুলতবি রাখা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভা পরিচালনা করেন। কমিটির ৫৪ জন সদসে৵র মধে৵ ৪২ জন উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরাও সভায় ছিলেন।

দিল্লি অভিমুখে শান্তিপদযাত্রা

বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য জনমত গঠনে দিল্লির দিকে এদিনও শান্তিপদযাত্রা চলে। যাত্রীরা শান্তিনিকেতনে পৌঁছালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত তাঁদের স্বাগত জানান।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ছাত্রসংগঠনের ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে পদযাত্রার জন্য দলটি গঠিত হয়। নেতৃত্ব দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল খালেক। ১৪ অক্টোবর তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেন।

পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকির পটভূমিতে দিল্লিতে সন্ধ্যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের সঙ্গে আলোচনা করেন। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ফিরুবিনের আকস্মিক দিল্লি সফরের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি। তিনি ভারতকে সংযত থাকার অনুরোধ জানাবেন। পাকিস্তানকেও তাঁরা একই কথা বলছেন।

ভারতের ১১ জন সাংসদ এক খোলা চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং কংগ্রেসের সদস্যদের প্রতি
এক আবেদনে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সব রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সমবেত চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।

জাপানি পত্রিকায় ইয়াহিয়াকে ভর্ৎসনা

জাপানের জনপ্রিয় দৈনিক আসাহি সিম্বুন এবং ইয়োমিউরি সিম্বুন–এ এদিন পূর্ব বাংলায় অব্যাহত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে। কাগজ দুটিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন—এই তিন বৃহৎ শক্তি পূর্ববঙ্গে গণহত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আসাহি সিম্বুন বলে, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। ইয়োমিউরি সিম্বুন বলে, উপমহাদেশে শক্তিসাম৵ বদলে যাওয়ার শঙ্কায় বৃহৎ শক্তি পূর্ববঙ্গের গণহত্যা দেখতে চাচ্ছে না।

default-image

গেরিলা অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে কামান আক্রমণ চালান। প্রায় ১০ মিনিট গোলাবর্ষণের পর মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল উত্তর দিক থেকে পাকিস্তানি সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতর্কিত এই আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন।

এই অভিযানের পর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর চারটি বিমান কসবায় বোমাবর্ষণ করে। এই বিমান আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা হতাহত না হলেও বহু বেসামরিক লোক নিহত হন।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা হরিসরদার বাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করেন। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

এই সেক্টরের ঢাকা শহরের জন্য বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা গভর্নর হাউসের (বর্তমানে বঙ্গভবন) কাছে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড (তখন এর অবস্থান ছিল বঙ্গভবনের সামনের পার্কের পশ্চিম প্রান্তে দক্ষিণ পাশে) এলাকায় একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত এবং কয়েকজন সাধারণ নাগরিক আহত হন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিলির ভারতীয় অংশে প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ করলে বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। ৬ নম্বর সেক্টরের হিলির মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী এরপর পাল্টা বোমা বর্ষণ করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

পাকিস্তানের তৎপরতা

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় তাঁর দল এখন শুধু পাকিস্তানের বৃহত্তম দল নয়, জাতীয় পরিষদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, দশম খণ্ড; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৩ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৩ ও ২৪ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান