বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের পাঁচটি দলের সমন্বয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠনকে ভারতের সরকারি মহল ১০ সেপ্টেম্বর স্বাগত জানায়। তারা বলে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাসংগ্রামে এটি নতুন অধ্যায়। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ও পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল এ দিন প্রথম প্রকাশ্যে জানান, বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করছেন।

তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের রাজনৈতিক মূল্য
অপরিসীম। জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রশ্নটি উঠলে এই কমিটির বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে কথা বলার পূর্ণ অধিকার থাকবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রশ্নটি কীভাবে তোলা হবে, তা নিয়েও বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে ডি পি ধর ও টি এন কাউলের আলোচনা হয়।

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে একটি কূটনৈতিক সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, সিংহল সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এ দিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার বিষয়বস্তু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করা হলেও সূত্রটি জানায়, যেসব প্রশ্নে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ আছে, যেমন বাংলাদেশ, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তির তাৎপর্য এবং ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। শ্রীলঙ্কার কাছে বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। অথচ ভারত একে আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে মনে করছে। সোভিয়েত-ভারত চুক্তি সম্পর্কে শ্রীলঙ্কার মনোভাব হচ্ছে, বৃহৎ শক্তির উপস্থিতির ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনাই শুধু বাড়বে।

নেপাল সফররত তিন সদস্যের বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধিদল এই দিন কাঠমান্ডুতে সংবাদ সম্মেলনে বলে, তারা নেপালের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছে। তবে কূটনৈতিক কারণে সেসব কথা তারা প্রকাশ করেনি।

অঁদ্রে মালরোর চিঠি

প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ও ভাবুক অঁদ্রে মালরো পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণকে ভিয়েতনামের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের মতো জবাব দিতে বলেন। দিল্লিতে ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে লেখা চিঠিতে তিনি এ কথা বলেন। চিঠিটির ভাষ্য এই দিন প্রকাশ করা হয়।

উপমহাদেশের বাইরে

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স দেশটির কংগ্রেসকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারকে বলেছে, বাংলাদেশের শরণার্থীরা যাতে নিজেদের দেশে ফিরতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সব রকম চেষ্টা করতে হবে। তিনি কংগ্রেসে আবেদন জানান, কংগ্রেস যেন পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

সুইডেন সফররত যুক্তরাজ্য এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত আবু সাঈদ চৌধুরী দেশটির অ্যাফটনব্লাডেট পত্রিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক ফ্রেডারিকসনের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করেন। ফ্রেডারিকসন স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে একযোগে কাজ করবেন বলে আশ্বাস দেন।

ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, ৫ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশকারী অপারেশন ওমেগা দলের চারজন সদস্যকে কারাদণ্ড দিয়ে যশোর জেলে পাঠানো হয়েছে। ঢাকার ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন থেকে তাদের কাছে এই সংবাদ পাঠানো হয়।

পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ

অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সামরিক কর্তৃপক্ষ এ দিন রাষ্ট্রদ্রোহ, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, অননুমোদিত অস্ত্র বিতরণ, রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ নানা অভিযোগে আওয়ামী লীগের ১৪৫ জন এমপিএকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।

ফেনীর বিলোনিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী মুহুরী নদী পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড কামান আক্রমণ চালায়। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সারা দিন যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন।

২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে মর্টারের আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। কিছু বেসামরিক লোকও হতাহত হয়।

এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল নয়াপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান ছেড়ে পেছন দিকে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ক্যাম্প থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন।

চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের দুই দিক থেকে আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল কয়েকটি নৌকায় খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ভালুকার দিকে এগোলে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও এগারো; স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‍্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান