বিজ্ঞাপন
default-image

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু ৮ নভেম্বর সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় বলেন, পূর্ববঙ্গ সংকটের মূল রাজনৈতিক। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলেই এর সমাধান করতে হবে। নইলে ভারত উপমহাদেশে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির ঝড় বয়ে যাবে।

ভোজসভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গে যা ঘটছে, তা গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ায় লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সমস্যার এমন রাজনৈতিক সমাধান দরকার, যা পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে। তা হলেই তা কার্যকর হবে।

ইন্দিরা গান্ধী আলাদা করেও প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু এবং প্রধানমন্ত্রী সেবান দেলমাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী সেবান দেলমাস তাঁকে বলেন, ফ্রান্স থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র চালান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং তাঁর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কানাডা সরকারের প্রতিনিধিদের আলোচনা শেষে এই দিন এক যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতির যাতে আর অবনতি না হয়, বিশ্বের তা দেখা উচিত। ইশতেহারে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, সমাধান বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবি ও অধিকারের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।

ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দেওয়া ৩৬ লাখ ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছে। তবে ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার মূল্যের যন্ত্রাংশে ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানকে শুধু এই যন্ত্রাংশগুলোই দেওয়া হবে।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ৪ নভেম্বর ওয়াশিংটন পৌঁছানোর আগেই ইন্দিরা গান্ধীকে অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করার এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ইন্দিরার ওয়াশিংটন সফরের পর এই খবর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উত্তেজনা কিছুটা দূর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকেও কিছুটা শান্ত করবে। কারণ, কংগ্রেস পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, পাকিস্তান সরকারের জ্ঞাতসারেই এটি করা হয়েছে। ভুট্টো ও পাকিস্তানের সামরিক কর্তাদের বেইজিংয়ে ছুটে যাওয়ার এটাই সম্ভবত কারণ।

চীন হস্তক্ষেপ করবে

পাকিস্তানের বার্তা সংস্থা পিপিআই জানায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সিবিএসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে চীন হস্তক্ষেপ করবে।
চীন সফর শেষে রাওয়ালপিন্ডি ফিরে এ দিন বিকেলে ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

পাকিস্তানের কূটনৈতিক মহল এ দিন সাংবাদিকদের জানায়, ভুট্টোর চীন সফরের ফলাফল সরকারি মহলে নৈরাশ্য সৃষ্টি করেছে। ভুট্টোর সফরের ফল নিয়ে দুই রকম মত প্রকাশিত হচ্ছে। এক দলের ধারণা, পাকিস্তান-চীন আলোচনা মোটেই সফল হয়নি। হলে একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হতো। অন্যদের মতে, চৌ এন লাই এবং অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চে ফেং পির বিবৃতিতে পাকিস্তানের মনোবল চাঙা হয়েছে এবং ইসলামাবাদ তার প্রচারণায় বিবৃতিটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে।

ভুট্টোর চীন সফর নিয়ে এ দিন দ্য টাইমস-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, বেইজিং ছাড়া আর কোনো রাজধানীতে কূটনৈতিক আলোচনার জন্য প্রতিনিধি না পাঠানোয় বোঝা যায়, পাকিস্তানের অবস্থান খুব দুর্বল। ভুট্টো তাঁর ব্রিফকেসে সরকারি বিবৃতির কপি না নিয়ে বেইজিং ত্যাগ করায় মনে হচ্ছে, চীন এখনো পাকিস্তানকে সরাসরি সাহায্য দেওয়া সম্পর্কে মনস্থির করেনি।
ভুট্টোর চীন সফরের সংবাদ ইন্দিরা গান্ধীকে স্বস্তি দেবে বলে সম্পাদকীয় মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়।

বিদ্যুৎকেন্দ্রে সফল অভিযান

নারায়ণগঞ্জে অভিযানের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল এই দিন নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ধ্বংস করে।

২ নম্বর সেক্টরের অধীন গেরিলাযোদ্ধারা ঢাকা শহরের কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালান। একটি দল এ দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। অপর দল ঢাকা কলেজের ভেতর বোমা ফাটায়। আরেকটি দল আরমানীটোলায় বাওয়ানি একাডেমিতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

১ নম্বর সেক্টরে একদল মুক্তিযোদ্ধা রামগড়-করেরহাট সড়কে পাকিস্তানের একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করেন। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণে হেঁয়াকুতে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটির সেনারা ফটিকছড়ির দিকে পিছু হটে। হেঁয়াকু বাজার মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল এ দিন বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। প্রথম দলটি ঘুনাথপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করলে তিনজন হতাহত হয়। দ্বিতীয় দল সাদীপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করলে দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দল মেহেরপুরের গাংনীর ভারত-সীমান্তবর্তী কাথুলীতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলের ওপর আক্রমণ করে। দুই পক্ষের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৯ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৯ ও ১০ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ৮ নভেম্বর, ১৯৭১; দ্য টাইমস ৮ ও ৯ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ৯ নভেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান