বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ২৯ নভেম্বর সকালে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিঠি দেন। নিক্সন ইন্দিরা গান্ধী ও ইয়াহিয়া খানকে চিঠিতে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনকেও নিক্সন এক চিঠিতে দিল্লি ও ইসলামাবাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের অনুরোধ জানিয়েছেন।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর দিল্লি সংবাদদাতার খবরে বলা হয়, মূল সমস্যা সমাধানের কোনো প্রস্তাব করা হয়নি বলে নিক্সনের যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান উপেক্ষা করা হবে বলে ধারণা করা হয়।

ভারত সরকারের এক মুখপাত্র জানান, পাকিস্তানই প্রথম সেনাসমাবেশ শুরু করেছে বলে দিল্লি তার মনোভাব বদলায়নি। পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য বেলজিয়ামের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার প্রস্তাবে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও দ্বিধায়। প্রস্তাবের ব্যাপারে ভারত বেলজিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

দিল্লি থেকে দ্য গার্ডিয়ান-এর বিশেষ সংবাদদাতার সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে বেলজিয়ামের প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, পরিষদের অধিবেশনে মূল সমস্যার সমাধান হবে না।

পাশ্চাত্যের দেশ সফরকালে ইন্দিরা বলেছেন, উপমহাদেশের বর্তমান সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে লাভ নেই। পাকিস্তান এ পর্যন্ত তিনবার ভারত আক্রমণ করলেও নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্ট ভাষায় তা কখনো বলেনি।

আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনের উদ্বেগ

আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সামরিক ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে শেখ মুজিবকে মার্জনা করতে তারা এক তারবার্তায় ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানায়। বিচার সম্পকে৴ কমিশন পাকিস্তানকে কিছু প্রশ্নেরও সুস্পষ্ট উত্তর দিতে বলে।

পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সংসদে নীতিসংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অনুরোধ জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতাই যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। এ ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে কি না, তা এখনো ঠিক হয়নি।

জাতিসংঘের একটি সূত্র জানায়, ভারত বা পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ না জানালে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসার সম্ভাবনা নেই। জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন এদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।

চীনের সহকারী প্রধানমন্ত্রী লি শিয়েন লিয়েন আলবেনিয়া সফরকালে এক অনুষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তান-ভারত বিরোধ মীমাংসা করার আহ্বান জানান।

রাধানগরের যুদ্ধ

সিলেটের রাধানগরে দুপুর থেকে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা ও আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গণবাহিনীর সদস্যসহ রাধানগরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালান। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ করার কথা ছিল। তা না হওয়ায় তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক এস আই এম নুরুন্নবী খান (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) তাঁর কোম্পানি এবং আলফা ও গণবাহিনী সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানিদের রাধানগর অবস্থানে আক্রমণ করেন। সন্ধ্যার মধ্যেই বেশ কিছু এলাকা মুক্ত হয়ে যায়।

রাত ১০টায় পাকিস্তানিরা ছোটখেলে তীব্র আক্রমণ করে বসে। প্রবল আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণের পর রাত ১২টায় পাকিস্তানিরা রণে ভঙ্গ দেয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগরের দিকে এগিয়ে যান। রেডিও পাকিস্তান রাতের খবরে রাধানগর কমপ্লেক্সের পতনের কথা স্বীকার করে।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের ভারত সীমান্তবর্তী সামরিক গুরুত্বপূর্ণ নাভারন মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোয় আক্রমণ করে একটু একটু করে এগোতে থাকেন।

পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে

পাকিস্তান এদিন পূর্ব পাকিস্তানে ভারত সীমান্ত বরাবর পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে নোট পাঠায়। ইয়াহিয়া খান স্বাক্ষরিত নোটটি সকালে জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহি জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারির হাতে দেন।

পাকিস্তানে সফররত তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওসমান ওলেকজাস রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে বলেন, প্রয়োজনে তুরস্ক পাকিস্তানকে সাহায্য করবে।

অধিকৃত বাংলাদেশের সামরিক আইন প্রশাসক ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

সূত্র: রাধানগর যুদ্ধ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এস আই এম নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম, প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১৩; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৩০ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য গার্ডিয়ান, ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১; ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ৩০ নভেম্বর, ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান