বিজ্ঞাপন
default-image

ব্রিটেন সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১ অক্টোবর লন্ডনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। তাঁরা দুজনই আলোচনায় একমত হন যে পাকিস্তানের শাসক এবং বাংলাদেশের স্বীকৃত নেতাদের নিয়েই বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। এ জন্য কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করার জন্য পাকিস্তানকে রাজি করাতে হিথ যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে ইন্দিরা তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আশ্বস্ত হতে চান।

আলোচনার পর ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা, ভারতে শরণার্থীদের বোঝা, ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারত-সোভিয়েত চুক্তি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের নেতাদের ধারণা এখন অনেকটা স্পষ্ট।

ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশ সংকটের জরুরি প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইন্দিরা ও হিথ দুজনই পুরোপুরি একমত হয়েছেন। যুক্তরাজ্য মনে করছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে দেরি করলে পাকিস্তানের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

যুক্তরাজ্য সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বালিসিয়ামে এক সভায় বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলবে না।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট নাকচ করে দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের জন্য বৈদেশিক সাহায্য কর্মসূচি বহাল রাখতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। তিনি উপদেষ্টাসহ রিপাবলিকান নেতাদের সঙ্গে আলাপে কর্মসূচিটি বহাল রাখার জোরালো দাবি জানান।

যুক্তরাজ্যে ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে মরিশাসের কৃষিমন্ত্রী স্যার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেনও ছিলেন। আবদুল মোমেন বাংলাদেশকে মরিশাসের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সমর্থন দিতে আবদুর রাজ্জাককে অনুরোধ করেন। জবাবে তিনি বলেন, পাকিস্তান ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রসঙ্গত, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউসাগর রামগোলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে থাকলেও তাঁর দলের মুসলিম সদস্যদের বিরোধিতার ফলে তা পারেননি।

রাষ্ট্রের সব বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের আছে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় এই দিন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি আয়োজিত সভায় বাংলাদেশ সরকারকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি দানসহ জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশনে যোগদানের অনুমতি দাবি করা হয়। কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী প্রস্তাবটি সমর্থন করে বলেন, রাষ্ট্রের সব বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের আছে।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনজীবন রাম মধ্যপ্রদেশে এক জনসভায় বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তাই আগ বাড়িয়ে কিছু করবে না। কিন্তু পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে যুদ্ধ হবে পাকিস্তানের মাটিতে। এর আগে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর অনুষ্ঠানেও তিনি বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তবে ভারত আক্রান্ত হলে বা এর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে অবশ্যই যুদ্ধ করবে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা মহানগরীর জন্য বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা এ দিন রাতে সার্কুলার রোডে নির্বাচন কমিশন অফিসে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযান চালানোর আগে তাঁরা বেসামরিক লোকদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে বোমার বিস্ফোরণ ঘটান।

পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস থেকে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে একই সেক্টরের চাপিতলার মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে এসে আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দিনব্যাপী যুদ্ধে গোলাবারুদ শেষ হয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

একই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীর কটেশ্বর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের শার্শার পশ্চিমে সাহেববাড়ীতে একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচজন হতাহত হয় এবং তিনজন আত্মসমর্পণ করে।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ধর্মদহে একদল পাকিস্তানি সেনাকে অ্যামবুশ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও আট; দ্য অবজারভার, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১ ও ২ নভেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান