বিজ্ঞাপন
default-image

পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা তড়িঘড়ি করে ঢাকা ত্যাগ করছিলেন। খবরটি দিনভর নানা জল্পনার জন্ম দেয়। রাত আটটায় ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ছাড়লে গুজবের সঙ্গে যুক্ত হয় আশঙ্কা। শহর থমথমে হয়ে পড়ে। মানুষ আঁচ করতে পারছিল, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে গণহত্যার পরিকল্পনা নিয়ে রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, ভারী অস্ত্রে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালাবে, বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেবে—তা ছিল কল্পনার বাইরে।

সকালে পাকিস্তানি নেতাদের কর্মকাণ্ডে সেই নির্মমতার বিন্দুমাত্র আভাস ছিল না। ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে বৈঠক হয়। এর আগে সকালে সংবাদপত্র থেকে মানুষ জানতে পারে, পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ নেতা আগের দিন তাড়াহুড়ো ঢাকা ত্যাগ করেছেন। দুপুর থেকে গুঞ্জন ছিল, সামরিক আইন প্রত্যাহার করে কেন্দ্রে আপাতত ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার গঠন করা হবে, প্রদেশগুলোয় নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে, পার্লামেন্টের বাইরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যরা আলাদাভাবে মিলিত হয়ে ৬ দফার প্রেক্ষাপটে সংবিধানের জন্য সুপারিশ করবেন ইত্যাদি।

ইয়াহিয়া খানের প্রস্থানের খবর শুনে রাত নয়টার পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করবে, এই অনুমানে ছাত্র-জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করে।

খবর পেয়ে রাত নয়টার পর আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া সামরিক সমাধানের পথ খুঁজছেন। এর মাধ্যমে তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন। রাত ১০টায় তিনি কিছু নির্দেশ জারি করে জনতাকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

বিভীষিকার রাত: রাত সাড়ে ১১টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর শুরু করে তাদের গণহত্যা-মিশন ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ব্যাপক নিধনযজ্ঞের প্রস্তুতি নিয়ে তারা বেরিয়ে আসে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে। ছাত্র-জনতা বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনারা প্রথম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় ফার্মগেটের কাছে। প্রতিরোধকারীদের তারা হত্যা করে। সেনাবাহিনী লাউড স্পিকারে গোটা ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারির ঘোষণা দিয়ে ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকে। সাঁজোয়া যানের আওয়াজ, গুলির শব্দ, গোলার বিস্ফোরণ আর মানুষের আর্তচিৎকারে ঢাকা বিভীষিকার শহরে পরিণত হয়।

সেনাবাহিনী পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধ্বংসী হামলা চালায়। রাত আনুমানিক একটায় তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। খুঁজে খুঁজে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। পিলখানায় এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাঙালি সেনা ও পুলিশরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। সেনাবাহিনী রাত দুইটার পর ইপিআর হেডকোয়ার্টার এবং ভোরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস দখল করে।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক কোয়ার্টার, ইপিআর ও পুলিশ ব্যারাকসহ আবাসিক এলাকা ও বস্তির বাসিন্দাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালিয়ে সেনাবাহিনী নজিরবিহীন গণহত্যার সূচনা করে। তারা নির্মমভাবে হত্যা করে হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে। ট্যাংকের গোলায় বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখায় ঢাকা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তারা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লাঞ্চার, মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলে। তাদের নির্মম আক্রমণে ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) অসংখ্য ছাত্র নিহত হয়।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা বাসায় গিয়ে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করে। তারা অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব ও তাঁর পালিত কন্যা রোকেয়া সুলতানার স্বামীকে হত্যা করে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে হত্যা করে তাঁর ছেলে ও আত্মীয়সহ। তাদের গুলিতে গুরুতর আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। তিনি পরে হাসপাতালে মারা যান। নিহত হন জগন্নাথ হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। হত্যাকাণ্ডের আরও শিকার হয়েছিলেন ভূবিজ্ঞানের অধ্যাপক মুকতাদির। সে রাতে জগন্নাথ হলে ৩৪ জন ছাত্র শহীদ হয়।

পাকিস্তানি সেনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ নম্বর নীলক্ষেতের বাড়িতে অধ্যাপক ফজলুর রহমানকে তাঁর দুই আত্মীয়সহ হত্যা করে। ঢাকা হলে হত্যা করা হয় গণিতের অধ্যাপক এ আর খান খাদিম এবং অধ্যাপক শরাফত আলীকে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। মধ্যরাতের আগেই ছাত্রলীগের প্রায় সব নেতা-কর্মী হল ছেড়ে গিয়েছিলেন। সেই রাত থেকে পরের সারা দিনরাত ওই হলে প্রচণ্ড আক্রমণ চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে এ মুনিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭১-৭২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, শুধু সেখানেই প্রায় ২০০ ছাত্র নিহত হন।

২৬ মার্চ সকালে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকথন হয়, তা থেকে জানা যায়, ক্যাম্পাসে প্রায় ৩০০ জন নিহত হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাস এবং মধুদার ক্যানটিনের মালিক মধুসূদন দের বাড়িতে হামলা করে তাঁকে হত্যা করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে হত্যা করে। ২৩ নম্বর নীলক্ষেত আবাসের ছাদে আশ্রয় নেওয়া নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি পুলিশ, প্রেসিডেন্ট হাউস (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) প্রহরারত বাঙালি ইপিআর এবং নীলক্ষেত রেলসড়ক বস্তি থেকে আগত প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করে লাশ ফেলে যায়।

চট্টগ্রামে ইপিআরের বিদ্রোহ: রাত ১০টায় ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের (পরে মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ইপিআর সেক্টরের বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। রফিকুল ইসলাম সেক্টর হেডকোয়ার্টারের বাঙালি সেনাদের নিয়ে সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। শহরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে নেন তাঁরা রাত পৌনে ১১টার মধ্যে।

সূত্র: ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ ১৯৭১; ডেইলি টেলিগ্রাফ, ৩০ মার্চ ১৯৭১; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর, রফিকুল ইসলাম; বাংলাদেশের তারিখ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মাওলা ব্রাদার্স; লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, রফিকুল ইসলাম, অনন্যা।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান