বিজ্ঞাপন
default-image

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স পৃথকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে তাঁদের দুই দেশের সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে ২৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার খবর পাওয়ার পর দুই দেশের কূটনীতিকদের ডেকে আনা হয়। ভারতের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনার সময় উইলিয়াম রজার্স উপমহাদেশের উত্তেজনা প্রশমনে কোনো নতুন প্রস্তাব দেননি। তবে তিনি দুই দেশকেই সংঘর্ষে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের পূর্ব খণ্ডে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বাহিনী মোতায়েনেরও কোনো প্রস্তাব করা হয়নি।

নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ব্যক্তিতভাবে আবেদন জানাবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ভারত উপমহাদেশের সমস্যা বিবেচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ জানানোর বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিবেচিত হচ্ছে।

ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে, তার জন্য প্রভাব খাটাতে যুক্তরাজ্যের সহায়তা চেয়েছে পাকিস্তান। সেখানকার পাকিস্তানি হাইকমিশনার মহম্মদ ইউসুফ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে ইয়াহিয়া খানের একটি চিঠি পৌঁছে দেন।

মস্কোর একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যেসব দল আন্দোলন চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসার দাবি জানিয়ে পাকিস্তানের কাছে একটি নোট পাঠিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিকে জটিল ও সংকটজনক করে না তোলার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে আবার অনুরোধ করেছে। পাকিস্তান যুদ্ধের পথই বেছে নিলে তাকে সর্বনাশা পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বলে সতর্ক করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

চীনের সরকারি পত্রিকায় বলা হয়, ভারত পূর্ববঙ্গে আক্রমণ করেছে। পাকিস্তানের বন্ধু হয়েও যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিচ্ছে চীন। কারণ, তারা বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চায়। নিউ চায়না এজেন্সি পরিবেশিত আরেক খবরে বলা হয়, বেইজিংয়ে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারের সঙ্গে এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে সাম্প্রতিক সামরিক পরিস্থিতিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়া খানের একটি চিঠি চৌ এন লাইকে দেন কায়সার।

শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এদিন আবার ঘোষণা করে, কলম্বো হয়ে বিমানে পূর্ববঙ্গে সেনা ও অস্ত্র পাঠানোর জন্য পাকিস্তানকে তারা কখনো সুযোগ-সুবিধা দেয়নি।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষকে বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তানিরা তাদের নাগরিকদের এক অংশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে রীতিমতো ভুল করেছে। ৮০ লাখ থেকে এক কোটি আক্রান্ত নাগরিককে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করা তাদের কৌশলগত ভুল। এতে ভারত গুরুভার বহন করতে বাধ্য হয়। ভারত আশ্রয় ও সামরিক শিক্ষা দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করে। প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান তার সংকীর্ণতার জন্য বাঙালিদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়ান্ত্র ব্যবহার করে। পরিণামে এ যুদ্ধ।

নিউইয়র্ক টাইমস–এর সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ কলকাতা থেকে পাঠানো সংবাদ বিশ্লেষণে বলেন, পূর্ববঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ভারতের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তারা অবিচল এবং নিরাপস। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও তারা মেনে নিয়েছে। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা শনবার্গকে বলেন, ভারত যুদ্ধ শুরু করবে না। তবে পাকিস্তান শুরু করলে তারা নিজের লক্ষ্য অর্জনে সব করবে।

মুক্তিবাহিনীর যশোর দুর্গ দখলের লড়াই

মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনী ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় যশোরের ঝিকরগাছা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে তাদের ঘাঁটিগুলো দখল করে। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে যায়। যশোরের অনেক এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়।
ঝিকরগাছা দখলের পর যৌথ বাহিনী যশোর শহরে পাকিস্তানি সেনাদের তিন দিক থেকে অবরুদ্ধ করে। তাদের সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কুষ্টিয়া-খুলনা যোগাযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খুলনা–উত্তরবঙ্গ রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যশোর বিমানক্ষেত্রও হয়ে পড়ে অকেজো। একটি বিমান পাকিস্তানি সেনা নিয়ে এসেও যৌথ বাহিনীর কারণে নামতে পারেনি।

বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র রাতে জানায়, এক সপ্তাহ যুদ্ধের পর রংপুর ও দিনাজপুরের প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। সাতক্ষীরার কয়েকটি থানা মুক্ত।

কুষ্টিয়ার অনেক এলাকা এদিন মুক্ত হয়। মেহেরপুর দখল নিয়ে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিবাহিনী ঝিনাইদহের মহেশপুর মুক্ত করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করে ৯টি গ্রামে বেসামরিক প্রশাসন চালু করেছে। ভেড়ামারা থেকেও পাকিস্তানি সেনারা বিতাড়িত। দর্শনা থেকে তারা পালাচ্ছে। জীবননগর মুক্তিবাহিনীর করায়ত্ত।

পাকিস্তান সেনারা দিনাজপুর শহরের আমবাগান ছেড়েছে। পঞ্চগড় ও কানপুর মুক্ত।
তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী নোয়াখালীর বসিরহাট দখল করেছে; ছিনিয়ে এনেছে ফুলগাজী, আনন্দপুর আর চাঁদগাজী বাজার। পরশুরাম এলাকা মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্বে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা দখলে নিয়েছে।

চীন–পাকিস্তান বন্ধুত্ব

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন তক্ষশীলায় চীনের সাহায্যপুষ্ট একটি কারখানার উদ্বোধনীতে বলেন, পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে উপমহাদেশের শান্তি বিনষ্ট করেছে ভারত। তবে বিদেশি আক্রমণ হলে চীন পাকিস্তানকে পূর্ণ সমর্থন জানাবে।

অনুষ্ঠানে চীনা প্রতিনিধি লি সুই চিং বলেন, চীন–পাকিস্তানের বন্ধুত্ব ক্রমে গভীর হচ্ছে। দুই দেশেই অপর কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরোধী।

সূত্র: স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‌্যাডিক্যাল পাবলিকেশন্স, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৬ ও ২৭ নভেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান