ঢাকা এমনিতেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ৩ এপ্রিল লোকের মুখে মুখে জিনজিরার হত্যাযজ্ঞের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক আর ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। ‘জিনজিরায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ’ (‘অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট মিসক্রিয়্যান্টস অ্যাট জিনজিরা’) শিরোনামে হত্যাযজ্ঞের খবরটি বেরিয়েছিল মর্নিং নিউজ–এ। পাকিস্তানি সামরিক শাসনের অধীনে প্রকাশিত পত্রিকায় সে হত্যাযজ্ঞের পক্ষেই সাফাই গাওয়া হয়।
জাহানারা ইমাম তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘মর্নিং নিউজ–এর একটা হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম।...খবরে লেখা হয়েছে: দুষ্কৃতকারীরা দেশের ভেতরে নির্দোষ ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হয়রান করছে। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে জিঞ্জিরায় সম্মিলিত এ রকম একদল দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছিল। এলাকাটি দুষ্কৃতকারীমুক্ত করা হয়েছে।’
এই দিন চট্টগ্রামে বাঙালি ইপিআর সেনারা বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি দলের ওপর গেরিলা হামলা চালিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। বৃহত্তর সিলেটের শমশেরনগরে এবং পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করেন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে ঠাকুরগাঁওকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখে।
ঢাকাসহ বহু জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা কর্তৃত্ব নিয়ে নেওয়ার পরও পাবনা, সিলেট, নরসিংদী, রাজশাহী, লাকসাম, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সাতক্ষীরা, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার এই দিন মুক্ত ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচার হত্যা ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১ এপ্রিল সিনেটে বক্তব্য দেওয়ার পর ৩ এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রবার্ট ম্যাক প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, সরকারিভাবে এমন কোনো তথ্য তাঁদের জানা নেই। পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকায় পাকিস্তানের সরকারি বাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুদ্ধ সম্পর্কে সরকার সংযত থাকছে।
লন্ডনের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট পত্রিকায় ৩ এপ্রিল ‘অস্ত্রের মুখে ঐক্য’ (ইউনিটি অ্যাট গানপয়েন্ট) শিরোনামে বাংলাদেশ নিয়ে একটি বড় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব সম্ভবত হেরে গেছেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গৃহযুদ্ধের যে পথ বেছে নিয়েছেন, সে পথে না জেতার সম্ভাবনাই বেশি।’
পাকিস্তান সংকটের পটভূমি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রিপন সোসাইটিও একটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করে। রিপন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট লি উসপিৎজ এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন এ মার্গলিন ও প্রভাষক গুস্তাভ এফ পাপেনেকের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি এই পর্যালোচনা পেশ করেন। তাতে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, ত্রয়োদশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১; বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, সম্পাদনা: ফজলুল কাদের কাদেরী; একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম, (সন্ধানী প্রকাশনী); দৈনিক পাকিস্তান, ৫ এপ্রিল ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান