বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের লোকসভায় ২৪ মে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক হয়। বিতর্কের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিবৃতি দেন। এ ছাড়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং, পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেন্দ্রপাল সিং লোকসভা সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা তাদের কার্যকলাপে প্রতিবেশীদের প্রতি বন্ধুসুলভ মনোভাব এবং শান্তি ও মানবতার মৌল নীতিগুলো ধ্বংস করেছে। সমরতন্ত্র বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। এ ব্যাপারে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব আছে। রাজনৈতিক সমাধানে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তারা যথাযথভাবে শক্তি প্রয়োগ করলেই কেবল উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি আসা সম্ভব।

ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় ঘোষণা দেন, বিশ্ব যদি এই সমস্যার সমাধানে কিছু না করে, তাহলে নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য ভারতই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তিনি আরও বলেন, আপ্রাণ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভারত সব শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে পারেনি। অনেকেই এখনো খোলা জায়গায় আছে। প্রতিদিন ৬০ হাজার করে শরণার্থী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আসছে। এরা নানা ধর্ম, স্তরের ও বয়সের লোক। অনেকেই আহত। বাংলাদেশে এমন অবস্থা ফিরে আসা দরকার, যাতে সব শরণার্থী নিজ নিজ বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারে। এ জন্য তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া দরকার। এ অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারলে উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি আসবে না। ভারতের ক্ষতি করে পাকিস্তানে এ সমস্যার সমাধান আসবে না।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের দুষ্কর্মের দায় ভারতের ওপর চাপাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তান যাকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করেছে, তা ভারতেরও অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ নাগরিককে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করার অধিকার কি পাকিস্তানের আছে? ভারতকে আরও অনেক বেশি বোঝা বহন করতে হতে পারে। এটি জাতীয় সমস্যা, কিন্তু মূল সমস্যাটি আন্তর্জাতিক। ভারত বিশ্ববিবেক জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। জাতিসংঘের কাছেও আবেদন জানিয়েছে।

শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এই দিন ভারতের রেল কর্মচারীরা তাঁদের এক দিনের বেতন দেওয়ার ঘোষণা দেন। ঘোষণায় জানানো হয়, তাঁরা আনুমানিক ৭০ লাখ টাকা দেবেন।

আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান জানান, মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়ে যাঁরা অকর্মণ্য হয়ে পড়েছেন, সরকার তাঁদের পুনবার্সনে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে।

ফণীভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের তিন সদস্যের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল দিল্লিতে লোকসভার স্পিকার জি এম ধীলনের সঙ্গে দেখা করেন। অন্য দুজন ছিলেন জাতীয় পরিষদ সদস্য নূরজাহান মুরশিদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ সসদ্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।

সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রচারণার কাজে এই দিন লন্ডন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রওনা দেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত এনামুল হক তাঁর সফরসঙ্গী হন।

লোকসভার স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ফণীভূষণ মজুমদার জানান, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ এবং বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষকে জানাতে তাঁরা দিল্লি এসেছেন। তিনি জানান, তাঁরা সংসদ সদস্য এবং বিদেশি সরকারের প্রতিনিধি, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের ঘটনাবলি তাঁদের জানাবেন।

বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী ভূরুঙ্গামারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেন। তিনি অধিনায়কদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার বিষয়ে আলোচনা করেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তানি সেনারা ঝালকাঠির দৈহারীতে নির্বিচার গুলি চালিয়ে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চাঁদগাজীতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর একটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি, যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; পূর্বদেশ ও দৈনিক পাকিস্তান, ২৫ ও ২৬ মে ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর ভারত, ২৫ মে ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান