বিজ্ঞাপন
default-image

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ২৩ মার্চের পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।

সরকারি-আধা সরকারি কর্মচারীরা এই দিনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মস্থল বর্জন অব্যাহত রাখেন। সারা বাংলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝোলে। সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ ও যানবাহনে উড়ছিল কালো পতাকা। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। একই দিন সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য শপথ নেওয়া হয়।

ময়মনসিংহে এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুক্তিসংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আবার তাঁর সমর্থন জানান।

আর্টস কাউন্সিলে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সৈয়দ শফিকুল হোসেনের সভাপতিত্বে চারু ও কারুশিল্পীদের এক সভায় মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদ স্বাধিকার আন্দোলনে বাংলার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার উদ্দেশ্যে সাইক্লোস্টাইল করা দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী স্কেচ বিতরণ, পোস্টার ও ফেস্টুন প্রচার, পোস্টার-ফেস্টুনসহ মিছিল আয়োজন করার কর্মসূচি নেয়। ১৬ মার্চ বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করারও সিদ্ধান্ত হয়।

জাতীয় পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন ১১ মার্চ এক ঘোষণায় পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব বর্জন করেন। রেডিও পাকিস্তানের করাচি কেন্দ্রের বাংলা সংবাদপাঠক সরকার কবীর উদ্দিন বেতারে বঙ্গবন্ধুর খবর প্রচারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান বর্জন করেন।

আওয়ামী লীগ নেতাদের বিবৃতি: রেডিওতে প্রচারিত একটি খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবের কাছে পাঠানো পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর একটি চিঠি পরীক্ষাধীন এবং পাঞ্জাব আওয়ামী লীগের নেতা খুরশীদ শেখ মুজিবের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি চিঠি নিয়ে এসেছেন। এ প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, এই অসত্য সংবাদ প্রচারে তিনি দুঃখিত।

আওয়ামী লীগের নেতা ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জন্য পাঠানো খাদ্যবোঝাই মার্কিন জাহাজের গতিপথ বদল করে করাচি অভিমুখে প্রেরণের ঘটনায় উৎকণ্ঠা ও নিন্দা জানান।

ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি নেতারা: রাতে বিবিসির এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৩ মার্চ করাচি থেকে ঢাকা পৌঁছাবেন। খবরে আরও বলা হয়, প্রেসিডেন্টের একটি প্যাকেজ ডিলের প্রস্তাব নিয়ে ঢাকায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই প্রাদেশিক পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা আছে।

লারকানা থেকে লাহোর যাওয়ার পথে মুলতান বিমানবন্দরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন, পিপিপি এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে চায়, যাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। তাঁরা চান জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার জন্য আমার দল সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত।’

লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বলেন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, দোষ করা হলো লাহোরে, কিন্তু বুলেট বর্ষিত হলো ঢাকায়। পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য এখন মাত্র একটিই পথ খোলা রয়েছে, আর তা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রথম ফ্লাইটে ঢাকা যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘হাতে সময় খুবই কম। আপনি ঢাকা গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানর সঙ্গে বৈঠকে বসুন।’

লাহোরে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।

সূত্র: ইত্তেফাক, ১৩ মার্চ ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান