বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর
স্বীকৃতি পাইনি আজও
একাত্তরের উত্তাল দিন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম শহর থেকে দলে দলে তরুণ যুবকেরা চলে যাচ্ছে যুদ্ধে। চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লার রাজাপুকুর লেনের আদিবাসী দুই ভাই স্থানীয় মুজিব বাহিনীর সংগঠক তরুণ রায় ও স্বপন রায় অনুমতি চাইলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। কিন্তু বাবা উত্পলাক্ষ রায় ও মা তপতী রায় বুকের ধনদের যুদ্ধে যেতে অনুমতি দিলেন না।
প্রতিবেশী বাঙালিরা যুদ্ধে না গেলেও অন্তত রাঙামাটি চলে যেতে পরামর্শ দিলেন তাঁদের। তরুণ আর স্বপন যে ছাত্রলীগ করেন এবং মুজিব বাহিনীর সংগঠক, সেটা রাজাকার-আলবদরেরা জানে। তাই চট্টগ্রামে থাকা নিরাপদ নয়। একদিন পাকিস্তানি সেনারা উত্পলাক্ষ রায়ের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করল। কিন্তু পরিবারটি চাকমা রাজার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় ফিরে আসে হানাদারেরা। এরপর তাঁদের ধারণা জন্মে, আর হয়তো অসুবিধা হবে না। উত্পলাক্ষ রায় ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এবং তরুণ রায় চট্টগ্রাম সিটি কলেজের স্নাতক শ্রেণী ও স্বপন রায় ওরফে চুচ্যাং কাজেম আলী উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র।
২৯ এপ্রিল ’৭১ সকালে উত্পলাক্ষ রায় তপতী রায়কে বললেন, অনেক দিন বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ির খবর পাই না। একটু ঘুরে আসব। দেখা করেই চলে আসব। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে উত্পলাক্ষ রায় দুই ছেলে তরুণ রায় ও স্বপন রায়কে নিয়ে রওনা হন পাথরঘাটার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে। পথে রাজাকার আর পাকিস্তানি হানাদারেরা তাঁদের তিনজনকে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেল। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, কিন্তু স্বামী আর দুই ছেলের দেখা নেই। অস্থির হয়ে উঠলেন তপতী রায়। খোঁজ নেওয়ার মতো বাড়িতে কেউ নেই। শুধু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছাড়া। অনিদ্রা আর রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে রাত কাটে। পরদিন কয়েকজন হানাদার স্থানীয় কয়েকজন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের বাড়িতে এসে তপতী রায়কে বলল, টাকাপয়সা যা আছে দেন। তাহলে আপনার স্বামী আর ছেলেদের ছেড়ে দেব। হাতে কোনো টাকা নেই বলে জানালে তপতী রায়কে স্বর্ণালংকার দিতে বলেন। তাও নেই বলে জানালে হানাদারেরা চলে যায়।
এরপর তপতী রায় তাঁর স্বামী ও দুই ছেলের আর কোনো খোঁজ পাননি। গত ৪০ বছর তাঁদের স্মৃতি বয়ে চলেছেন ৮৫ বছর বয়সী তপতী রায়। তিনি কয়েক দিন আগে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছেন। কিছুটা স্মৃতিভ্রমও হয়েছে, যার কারণে কোনো প্রশ্নের উত্তর সহজে দিতে পারেন না। অনেক ঘুরিয়ে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রশ্ন করলে তার পরই পাওয়া যায় উত্তর।
রাজাপুকুর লেনের বড় বড় দালানের মাঝখানে ছোট্ট একটি টিনশেডের ঘরে ছোট ছেলে আশীষ রায়ের পরিবারের সঙ্গে থাকেন তপতী রায়। সেখানে ৪ ডিসেম্বর কথা হয় তপতী রায়ের সঙ্গে। এ সময় আরও ছিলেন তাঁর মেয়ে পূরবী রায় ও ছেলে আশীষ রায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পূরবী রায় চতুর্থ আর আশীষ রায় প্রথম শ্রেণীতে পড়তেন। বর্তমানে পূরবী অগ্রণী ব্যাংকে আর আশীষ পরিসংখ্যান কার্যালয়ে চাকরি করছেন।
তপতী রায় বলেন, পরবর্তী সময়ে আমার স্বামী আর দুই ছেলেকে যে পাকিস্তানি সেনারা মেরে ফেলেছে, সেটা বলারও সাহস পেতাম না। স্বামী ও ছেলের শহীদ হওয়ার কোনো খবর কোথাও এ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। সরকারি কোনো নথিতে আছে বলেও জানা নেই। কেমন আছি, কীভাবে আছি, সেটা এই ৪০ বছরে কোনো সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তি খবর নেননি ।
হরি কিশোর চাকমা, রাঙামাটি
Also Read
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে আরও পেছাল বাংলাদেশ
-
প্রথম টি–টোয়েন্টি: জোড়া ‘জীবন’ পেয়ে খোলস ছাড়লেন তানজিদ
-
‘আমার বাবারে ওরা মাইরে ফেলছে’
-
‘আমার পোলাডাও গেল, লক্ষ লক্ষ ট্যাকাও জলে গেল’
-
সফর বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সাড়ে তিন মাসেই বিদেশ গেলেন প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জন