বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর
সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর অজানা বীরত্বগাথা
চারটি টাস্কফোর্সে বিভক্ত ছিল সাঁতারু মুক্তিবাহিনী। এরা ছিল চট্টগ্রাম, চালনা-খুলনা, নারায়ণগঞ্জ এবং দাউদকান্দি-চাঁদপুরে। প্রতিটি সেক্টরে ছিল চারটি করে টাস্ক ইউনিট। প্রত্যেক টাস্ক ইউনিটের ছিল ১০টি করে টাস্ক এলিমেন্ট। প্রতিটি টাস্ক এলিমেন্টে ছিলেন তিনজন করে সাঁতারু যোদ্ধা। প্রত্যেক যোদ্ধার ছিল প্রথমে একটি, পরে দুটি করে লিমপেট মাইন, একটি গ্রেনেড, একটি ছোরা, সাঁতারের জন্য পায়ে বাঁধা এক জোড়া তাড়নি এবং একটি করে কবজিতে বাঁধা কম্পাস
জলপথে যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন সেসব বাঙালি গেরিলাকে মুক্তিবাহিনীর অন্য যোদ্ধাদের থেকে আলাদাভাবে পরিচয় করানোর প্রয়োজন আছে। কেননা, তাঁদের বীরত্বের কাহিনি অকথিত। তাঁদের নাম দেওয়া চলে ফ্রগমেন। তাঁরা অন্তর্জলের সাঁতারু, মুখে শ্বাসযন্ত্র আর পায়ে তাড়নি বেঁধে জলের নিচে সাঁতার কাটায় ছিলেন সুদক্ষ। এই মুক্তিযোদ্ধা সাঁতারু বাহিনীর সাহসিকতা, দৃঢ়তা ও ত্যাগের কাহিনি আজও, সিকি শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, অকথিত অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
যেভাবে সংগঠিত হলো
সাঁতারু বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের মূল অংশটি গঠিত হয়েছিল বাঙালি নাবিকদের একটা মূল অংশকে ঘিরে, যাঁরা তৃতীয় পাকিস্তানি দাফনি সাবমেরিন ‘মানগ্রো’ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এই দুঃসাহসী বাঙালি নাবিকেরা ফ্রান্সে পাকিস্তানি সাবমেরিন থেকে পালিয়ে স্পেনে চলে যান। স্পেন থেকে তাঁরা পূর্ব বাংলায় ফিরে আসার পথ বের করেন। পরে এতে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের তরুণ ছাত্র এবং চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার তরুণ যুবকের দল। পূর্ব বাংলার দ্রুত প্রবহমান নদীগুলো থেকে যথাসম্ভব সুবিধা নেওয়ার মতো সাঁতারু কৌশল ও অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী তাঁরা ছিলেন। সম্পূর্ণ অন্ধকারে তাঁদের ডজন ডজন মাইল সাঁতরাতে হতো, বাঁশ বা পেঁপে পাতার চোঙা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে জমকালো অন্ধকার পানিতে মাইন বহন করে শত্রুপক্ষের কাছাকাছি রেখে সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই সাঁতারে নিরাপদ দূরত্বে ফিরে যেতে হতো, যা কিনা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেমস বন্ড ধরনের কমান্ডোদের জন্যও একটা কঠিন কাজ। এ ধরনের কাজের জন্য যে দৈহিক ও মানসিক শক্তিমত্তার প্রয়োজন পূর্ব বাংলার তরুণ যুবকদের তা প্রচুর পরিমাণে ছিল। তাই সাঁতারু বা ফ্রগমেন বাহিনীর নেতৃত্ব শুরুর দিকে নৌবাহিনীর সদস্যদের হাতে থাকলেও অচিরেই তা চলে যায় বিপুলভাবে উদ্দীপিত শিক্ষিত যুবকদের হাতে।
সাঁতারু মুক্তিবাহিনীতে ১৩০ জন ছিলেন চট্টগ্রামের, খুলনা-চালনা অঞ্চলের ছিলেন ১০০ জন, ৪০ জনকে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে এবং ৩০ জনকে চাঁদপুর, দাউদকান্দি এলাকা থেকে। তাঁদের ছিল সেই সাহসিকতা আর প্রাণশক্তি যার বলে তাঁরা এ রকম কষ্টকর, বিপজ্জনক ও দুঃসাহসী অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ রকম কাজ সাধারণত দেওয়া হয় উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপকে, যাঁদের বলা হয় মেরিন কমান্ডো, উন্নত নৌবাহিনীতে তাঁদের বলা হয় ‘সিলস’। সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিলেন মুসলমান। যে অল্পসংখ্যক হিন্দু যোদ্ধা ছিলেন তাঁরা খতনা করেছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন ধরা পড়লে এতে অন্তত প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা থাকতে পারে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসাররা করাচিতে গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন। একজন লেফটেন্যান্ট ছুটিতে পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন এবং একজন কমান্ডার ১৯৭১ সালের নভেম্বরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। মুক্তিবাহিনীতে নৌবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মাত্র এই দুজনই অংশ নিতে পেরেছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের বদ্বীপ অঞ্চলে নৌ-মুক্তিসেনাদের নেতৃত্ব গিয়েছিল শিক্ষিত এবং দৈহিকভাবে শক্তসামর্থ্য যুবকদের হাতে।
সাংগঠনিক কাঠামো
চারটি টাস্কফোর্সে বিভক্ত ছিল সাঁতারু মুক্তিবাহিনী। এরা ছিল চট্টগ্রাম, চালনা-খুলনা, নারায়ণগঞ্জ এবং দাউদকান্দি-চাঁদপুরে। প্রতিটি সেক্টরে ছিল চারটি করে টাস্ক ইউনিট। প্রত্যেক টাস্ক ইউনিটের ছিল ১০টি করে টাস্ক এলিমেন্ট। প্রতিটি টাস্ক এলিমেন্টে ছিলেন তিনজন করে সাঁতারু যোদ্ধা। প্রত্যেক যোদ্ধার ছিল প্রথমে একটি, পরে দুটি করে লিমপেট মাইন, একটি গ্রেনেড, একটি ছোরা, সাঁতারের জন্য পায়ে বাঁধা এক জোড়া তাড়নি এবং একটি করে কবজিতে বাঁধা কম্পাস। প্রত্যেকটি টাস্ক ইউনিটের ছিল একটি করে গুলিভরা রাইফেল। এই সামান্য অস্ত্র সরঞ্জাম নিয়ে বাঙালি সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর যুবকেরা যে অবিশ্বাস্য কাজ করেছেন, শত্রুপক্ষের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছেন, তা পৃথিবীর গেরিলা যুদ্ধগুলোর ইতিহাসে বিরল।
সর্বোচ্চ সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে তাঁরা প্রথম আক্রমণটি চালান একসঙ্গে একজোটে কয়েকটি স্থানে। সেটা ছিল একাত্তরের আগস্ট মাসের ১৫-১৬ তারিখের অন্ধকার রাত। একসঙ্গে তাঁরা আক্রমণ করেন চট্টগ্রাম, চালনা, খুলনা এবং নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশালের নদীবন্দরগুলোর ওপর। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত মনে করত বলে একসঙ্গে এতগুলো পয়েন্টে এমন অতর্কিত হামলায় তারা হকচকিত হয়ে গিয়েছিল।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজে হামলা
৩০ আগস্ট ১৯৭১
দক্ষিণাঞ্চলের নদীবন্দরগুলো ও জলপথগুলোর ওপর যখন আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে তখন, আগস্টের শেষ দিকে সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর একটি দল উত্তরে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। তাদের লক্ষ্য পদ্মা নদীর ওপরের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পদ্মা পেরিয়ে কুষ্টিয়া থেকে রাজশাহী-পাবনার দিকে রেল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ পথ। ১৩ জন সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহী পৌঁছান। তারপর তাঁরা সারদা নদী পেরিয়ে চারঘাটের দিকে এগোন এবং দাদুপুর চরে গিয়ে আশ্রয় নেন।
সাঁতারু দলের মধ্যে মোহাম্মদ কাইয়ূম হোসেন কাদের ও ওয়াহিদুল ইসলাম ছিলেন এই এলাকার মানুষ। তাঁরা একটি দেিশ নৌকা ছিনতাই করেন এবং ২১ হেরিক চার্জসহ আটজন সাঁতারুকে ওই নৌকায় লুকিয়ে রাখেন। একটা মোটরবোট ওই নৌকাটিকে টেনে নিয়ে যায় রাইতা পয়েন্ট পর্যন্ত, যা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে আধা মাইল উজানের দিকে। দেিশ নৌকাটি তারপর মোটরবোট থেকে আলাদা হয়ে নিজে ব্রিজের কেন্দ্রীয় পিলারের দিকে অগ্রসর হয়। সবার অগোচরে সেটি সেখানে পৌঁছায় ৩০ আগস্ট রাত একটায়। নৌকাটি রক্ষা করার জন্য দুজনকে সাঁতরে ব্রিজটির বিপরীত পাশের পিলারগুলোর দিকে যেতে হতো, কিন্তু তীব্র স্রোতের কারণে দুজন সাঁতারু তা করতে ব্যর্থ হন। তখন নোঙর ফেলা হয় সরাসরি ব্রিজটির নিচেই। নৌকাটি ঝাঁকুনি খেয়ে আটকে যায় এবং তৎক্ষণাৎ নৌকার সম্মুখভাগ তীব্র স্রোতের কারণে পানিসীমার নিচে একটা গোত্তা খায়। বৈঠাচালক ভয় পেয়ে পুরো শিকল খুলে ছুড়ে ফেলে দেন। তখন নৌকাটি ভাটির দিকে চলে যায় এবং খুব কষ্টে সে রাতের জন্য রক্ষা পায়।
পরের দিন রাত ১০টায় দ্বিতীয়বারের মতো তাঁরা চেষ্টা করেন। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হন। তৃতীয়বার তাঁরা তীরের কাছাকাছি একটা পিলারকে লক্ষ্য হিসেবে নেন। এবার তাঁদের সফলতার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ব্রিজের ওপর থেকে সেন্ট্রিরা নৌকার ওপর গুলি করে। মুক্তিযোদ্ধারা লাফিয়ে পড়ে ভাটির দিকে সাঁতরাতে থাকেন। এরই মধ্যে নিকটস্থ একটা রাজাকার ক্যাম্পকে সৈন্যরা সতর্ক করে দেয়। রাজাকাররা কাদির এবং ওয়াহিদকে ধরে ফেলে। এরপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অন্যরা আশপাশের আখখেতে গা-ঢাকা দেন এবং প্রায় মাঝরাতের দিকে পৌঁছান বাজুমেরা। তারপর আবদুলপুর-নন্দনগাছির মধ্যে রেলপথের ওপরে আড়ানি সেতু নষ্ট করে তাঁরা তাঁদের ঘাঁটিতে ফিরে যান। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আক্রমণের ব্যাপারে সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান এই জাতীয় সম্পদ স্বাধীনতার পর বাঙালিকেই মেরামত করতে হবে এবং তার পেছনে অনেক শ্রম ও অর্থ ব্যয় হবে, এমন উপলব্ধি তাঁদের দ্বিধান্বিত করেছিল।
মুক্তিবাহিনীর সাঁতারু দল ছিল একটি ছোট্ট গেরিলা বাহিনী, পূর্ব বাংলার নদীনালা খালেবিলে এরা মাছের মতোই স্বচ্ছন্দে চলতে পারত। এই স্বল্পসংখ্যক তরুণ-যুবক তাঁদের অপরিসীম সাহসিকতা, মাতৃভূমির জন্য ভালোবাসা, কষ্টসহিষ্ণুতা আর দৃঢ়তার বলে চট্টগ্রাম, চালনা, মংলা ও খুলনা পূর্ব পাকিস্তানের এ প্রধান চারটি বন্দর অচল করে দিয়েছিলেন। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বন্দরগুলোর পরিচালকেরা বন্দর বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো তাদের জাহাজ পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সাঁতারু মুক্তিবাহিনী ভারতীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তার মাত্র ১০-১২ দিনের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
ভাইস অ্যাডমিরাল মিহির কে রায়ের ওয়ার ইন দি ইন্ডিয়ান ওশান বই থেকে মশিউল আলমের অনুবাদ
ভাইস অ্যাডমিরাল মিহির কে রায় পিভিএসএম, এভিএসএম: ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে