বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর

ষোলোই ডিসেম্বর

আনিসুজ্জামান

১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বরে কী যে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম আমরা, চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম অনাস্বাদিত আনন্দে, বুক ফুলে উঠেছিল সমষ্টিগত সাফল্যে। কোটিখানেক শরণার্থী উদেযাগ নিয়েছিল স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনের; দেশের মধ্যে যারা ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছিল নটি মাস—শামসুর রাহমানের ভাষায়, শ্বাসজীবীরা— নবজীবনের রৌদ্রে স্নান করেছিল তারা; দেশান্তরে মাতৃভূমির মুক্তির সাধনায় যারা উত্সর্গ করেছিল দিনরাত্রি, নতুন প্রত্যয়ে তারা পরস্পরের হাতে হাত রেখেছিল।

দুঃখ ছিল বইকি, স্বজন হারানোর দুঃখ। বিজয়লাভের প্রাক্কালে ঘাতকের হাতে নিহত সোনার মানুষগুলোর জন্যে শোক ছিল; আশঙ্কা ছিল নিরুদ্দিষ্ট আপনজনের জন্যে; যুদ্ধে গিয়ে ফিরে আসেনি যারা, হাহাকার ছিল তাদের জন্যে।

উদেবগ ছিল: কী হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর, তিনি কি ফিরে আসবেন মুক্ত স্বাধীন স্বদেশভূমিতে—কবে, কখন, কিভাবে?

সেদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের স্বপ্ন ছিল চোখে, আত্মত্যাগের কোনো দাবিই মনে হয়নি অত্যধিক, কোনো বাধাই মনে হয়নি অলঙ্ঘনীয়।

২০০৫ সালের বিজয় দিবস উদ্যাপন করতে নিষেধ করেছে দুর্বৃত্তেরা; জানিয়ে দিয়েছে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসও পালনীয় নয়। সংবাদপত্রের পাতা থেকে জানছি, ডিসেম্বরের প্রচলিত অনুষ্ঠানমালায় কাটছাঁট হচ্ছে নিরাপত্তার কারণে। অভিজ্ঞতা থেকে জানছি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কেউ শেখ মুজিবের নামটি উচ্চারণ করবে না। সংকটের কালে সর্বস্ব দিয়ে যে-দেশটি এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পাশে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতাপ্রকাশের কোনো প্রয়াস থাকবে না।

সেই ষোলোই ডিসেম্বরে যারা লুকিয়ে গিয়েছিল গর্তে—প্রাণ বাঁচাতে, মানুষের রোষ থেকে রক্ষা পেতে—গাড়িতে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে তারা দেশবাসীকে আজ নসিহত করবে, দেশপ্রেমের দীক্ষা দেবে।

প্রাণের মেলায় যোগ দিতে যাবে যারা, বারবার ঘাড় ফিরিয়ে তারা দেখবে, দেশের শত্রুরা কত কাছে এসে পড়েছে। উত্কর্ণ হয়ে হয়তো কেউ জিজ্ঞাসা করবে অন্য কাউকে, ঘাতকের পদধ্বনি শুনিতে কি পাও?

কেন এমন হলো? এমন হবার কথা তো ছিল না।

এ আমার এ তোমার পাপ।

স্বাধীন হওয়ার পর দেশটা যেভাবে চালানো উচিত ছিল, সেভাবে আমরা চালাতে পারিনি। ক্ষুদ্র স্বার্থ, সংকীর্ণ বুদ্ধি, অতিবিপ্লবী ভাব পদে পদে বিড়ম্বিত করেছে আমাদের। যে-সংবিধানে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তা নষ্ট করার সূচনা করেছি নিজেরাই।

আমরা ভুল করেছি, তার মাশুল গুনতে হচ্ছে।

আমরা প্রতিবাদ করিনি, যখন প্রতিবাদ করার প্রয়োজন ছিল তখন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো, আমরা প্রতিবাদ করিনি। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করা হলো, আমরা প্রতিবাদ করিনি। ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জিত হলো সংবিধান থেকে, আমরা প্রতিবাদ করিনি। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার দ্বার অর্গলমুক্ত হলো, আমরা প্রতিবাদ করিনি। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলো, আমরা মৃদু প্রতিবাদের বেশি করিনি।

পাহাড়িদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, আমরা কিছু বলিনি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়েছে, আমরা সমস্বরে নিন্দা করিনি।

ধর্মব্যবসায়ীরা সামরিক প্রশিক্ষণের ঘাঁটি খুলেছে, আমরা উদিবগ্ন হইনি। অস্ত্রের চোরাচালান ধরা পড়েছে, আমরা শঙ্কিত হইনি। ধর্মের নামে কী করছে বেসরকারি সংস্থাগুলো, আমরা খোঁজ নিইনি।

নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে থাকা মানুষ যখন একের পর এক হার্টফেল করেছে, তখন আমরা তার নিন্দা করিনি। দোষী হোক, নির্দোষ হোক, বিনাবিচারে যখন ক্রসফায়ারে মরছে শত শত মানুষ, আমরা তার প্রতিবাদ করছি না। বেসরকারি বাহিনী মানুষ মেরে গাছের ডালে টাঙিয়ে রেখেছে, আমরা তার বিরুদ্ধে সরব হইনি।

তেষট্টি জেলায় যখন বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে, তখন আমরা একটু নড়াচড়া করার উদেযাগ নিয়েছি। আদালত যখন আক্রান্ত হয়েছে, আত্মঘাতী বোমায় মানুষ যখন মরছে, তখন আমাদের চৈতন্য হয়েছে। বড়ো দেরি হয়ে গেছে, ভাই।

আপনাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আপনার ঘরবাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হবে বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আপনার প্রতিষ্ঠান নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়েছে। আপনি উদিবগ্ন।

এসবের চেয়ে অনেক বেশি কিছু আজ হুংকারের সম্মুখীন—আমাদের মৌলিক অধিকার, আমাদের বিচারব্যবস্থা, আমাদের সংবিধান।

আজ আক্রান্ত বাংলাদেশ। ১৯৭১ এর মার্চ বুঝি ফিরে আসছে।

সেদিনের মতো বজ্রকণ্ঠে নির্দেশ দেওয়ার মতো কোনো নেতা নেই আজ। কেবল নিজের বিবেকই পারে পথ বলে দিতে।

তবে নিশ্চিত জানবেন, আক্রান্ত বাংলাদেশকে মুক্ত করেই শুধু বিজয় দিবসে পৌঁছোনো যাবে।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত