বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর
‘যারা বেঁচে আছ, প্রতিশোধ নাও’
আ ফ ম নিজাম চৌধুরী ছিলেন কোম্পানি অধিনায়ক, মিরসরাই থানা হাইকমান্ড, চট্টগ্রাম। ৯ নম্বর মিরসরাই সদর ইউনিয়নের জোরপুনি তাঁর গ্রাম। লেখাটি ১৯৭৩ সালের জুন মাসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক সুকুমার বিশ্বাসকে দিয়েছিলেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট এই মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক চলছিল বর্বর ইয়াহিয়া খানের। বাংলার নিরীহ জনগণ জানত না অন্ধকারে পাকিস্তানি হায়েনারা এত রক্ত পান করবে। ২৫ মার্চ রাতে মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন, গর্জে উঠল হিংস্র পশুর গর্জন—বন্দুক, কামান। চারদিকে লেলিহান অগ্নিশিখা। আগুনে ছারখার হয়ে যাচ্ছে বাংলার সম্পদ। নিরীহ মানুষের আর্তনাদ শুনতে পেলাম, শুনতে পেলাম মা-বোনের করুণ আবেদন। বুঝতে পারলাম বাঙালি জাতির আজ চরম দুর্দিন—তারা চায় বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু তারা তা কোনো দিন পারবে না। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে বলেছিলেন—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি প্রতি মুহূর্তে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর আমার চিত্তবীণায় সাড়া দিল। আমি স্থির থাকতে পারলাম না। আমার মন বিচলিত হয়ে উঠল।
এপ্রিলের প্রথম দিকেই আরম্ভ হলো গ্রামে গ্রামে দুর্ধর্ষ হানাদারদের অত্যাচার, দালালদের লুণ্ঠন। সুযোগসন্ধানীরা পাঞ্জাবিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নারী ধর্ষণ শুরু করল। তারা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিতে লাগল। নিরীহ মানুষ পালিয়ে বেড়াতে লাগল। তবু রক্ষা পেল না, নিষ্কৃতি পেল না। পথে পথে মানুষের শবদেহ ছড়িয়ে রইল। রইল তাদের আকুল আবেদন, ‘তোমরা যারা বেঁচে আছ, এর প্রতিশোধ নাও।’
আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। এপ্রিলের শেষ দিকে মাকে ছুঁয়ে শপথ নিলাম। বললাম, মা, আজ বাংলার মা-বোনের ওপর যে অত্যাচার, যে ধর্ষণ বর্বর হানাদাররা করে যাচ্ছে, আশীর্বাদ কোরো আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা যেন এর প্রতিশোধ নিতে ভুলে না যাই। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে, বিজয়ের মালা পরে যেন তোমার কাছে ফিরে আসতে পারি।
তারপর যাত্রা করলাম নিকটবর্তী মিত্রদের ভারতের উদ্দেশে। পাকিস্তানিদের অত্যাচারের সীমা শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সহ্য করতে না পেরে মানুষ মাতৃভূমি ত্যাগ করে মিত্র দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। আমিও গিয়েছিলাম।
ভারতের বিখ্যাত ‘অম্পি’ নামক সামরিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে ১২ জুন ট্রেনিং শেষ করি। পরদিন ১৩ জুন ফেনীর কাছে চাঁদগাজীতে সম্মুখযুদ্ধ করার জন্য আমাদের ২৯ জনের একটি দলকে পাঠানো হয়। সেখানে সাত দিন যুদ্ধ চলে। আমরা বিজয়ী হই। ২৫ জুন হরিণাতে ফিরে আসি। ৩০ জুন আমাকে সাতজনের একটি দলের অধিনায়ক করে শত্রুকবলিত মিরসরাই পুনরুদ্ধার করার জন্য পাঠানো হলো। মেজর শওকত যখন গ্রাম পরিদর্শন করতে যান তখন আমি ১ নম্বর সেক্টরে ছিলাম। মিরসরাই আমার নিজস্ব গ্রাম। তাই পথঘাট আমার অতি পরিচিত। সাতজনের দলের অধিনায়ক হয়ে গ্রামে ঢুকে দেখলাম, চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ, নরপিশাচেরা মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে, হত্যা করেছে। ছদ্মবেশ নিয়ে গ্রামের বহু লোকের সঙ্গে কথা বললাম। মুষ্টিমেয় কয়েকজন হানাদারের দালাল ছাড়া আর সবাই স্বাধীনতার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে ইচ্ছুক। মনে মনে উত্সাহিত হলাম। দ্বিগুণ সাহস নিয়ে মিরসরাই তথা বাংলার মাটিতে শত্রু হননের কাজ শুরু করলাম।
সেদিন ছিল ১১ জুলাই। গভীর রাতে সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়ে চললাম হেনাপোনি পুল উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। থানার প্রধান কার্যালয় থেকে কোয়ার্টার মাইলের পথ। অতি সন্তর্পণে সজাগ দৃষ্টি রেখে রাস্তায় উঠলাম। বিস্ফোরক ফিট করে রাস্তার পাশে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর বিকট আওয়াজ হয়ে পুলটা ভেঙে পড়ল। শত্রুরা ভয়ে চিত্কার করে বলল, ‘মুক্তি আগেয়া, উসকো গুলি করদো।’ পুল লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাল পাকসেনারা। ততক্ষণে আমরা নাগালের বাইরে চলে এসেছি। বর্বর দস্যুরা রাতে কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে অত্যাচার করল। কয়েকজনকে ধরেও নিয়ে গেল। যাদের ধরে নিয়ে যায়, তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১২ ঘণ্টা প্রাণপণ পরিশ্রম করে পাঞ্জাবিরা কোনো রকমে পুলটার ওপর দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা করল।
আমাদের দ্বিতীয় অপারেশন ছিল ১৪ জুলাই। সেদিন সকালবেলা স্থানীয় আবু তোরাব বাজারের একটি দোকানে বসে খাচ্ছিলাম। হঠাত্ নজরে পড়ল, লোকজন ছুটে পালাচ্ছে। একজন লোক এসে আমাদের তাড়াতাড়ি পালানোর জন্য নির্দেশ দিল। লোকজনের কাছে জানতে পারলাম, বাজার লুট করার জন্য হায়েনার মতো ওরা ধাওয়া করছে লোকজনদের। ওরা প্রায়ই এটা করে। হাতের কাছে ছিল একটা মাত্র গ্রেনেড। তিনজন প্রস্তুত হতে না হতেই ওরা কাছে এসে পড়ল। সময় নেই। কোনো রকম পজিশন নিতে পারলাম না। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুড়ে মারলাম গ্রেনেডটা। আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে দুই-তিনজনের হাত থেকে রাইফেল পড়ে গেল। আমরা কিছু দূরে সরে গেলাম। ওরা চারদিকে গুলি ছুড়ল। তারপর আহত সৈন্যদের নিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিল।
এরপর ১৮ জুলাই। হানাদার বাহিনী ট্রেনযোগে রসদ জোগাত প্রধান কার্যালয় জোরালগঞ্জে। গভীর রাতে সঙ্গীদের নিয়ে রেললাইনের দিকে এগোলাম। উদ্দেশ্য ছিল মাইন বসিয়ে রেললাইন ধ্বংস করা। হানাদারদের দৃষ্টি এড়িয়ে বড় রাস্তা পার হলাম। তারপর বারতাকিয়া এবং বারিয়াঢালার মধ্যবর্তী স্থান লিচুবাগানে এসে পৌঁছালাম। সেদিন আকাশ কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন ছিল। এরপর খুব বৃষ্টি নামল। আধঘণ্টার মধ্যে মাইন বসানোর কাজ শেষ করলাম। তারপর গন্তব্যস্থলে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সঙ্গীরা জেগেই ছিল। ওদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। শুনলাম ফেরার কিছুক্ষণ পরই মাইন বিস্ফোরণ ঘটেছিল। দুটো বগি নিয়ে ইঞ্জিনটা লাইনচ্যুত হলো। হায়েনার দল প্রতিশোধ নিল দুই পাশের নিরীহ জনগণের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে।
২৩ জুলাই মিরসরাই ও বারতাকিয়ার মাঝখানে আর একটি মাইন ব্রাস্ট করলাম। সেদিনও তারা নাজেহাল হয়ে গ্রামবাসীর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সেদিন কয়েকজন গ্রামবাসীকে তারা হত্যা করে পালিয়ে যায়।
২৮ আগস্ট। অমাবস্যার নিশুতি রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। মাঝেমধ্যে বিদ্যুত্ চমকানি। দলের শাহজাহানকে শুধু সঙ্গে নিয়ে রেললাইনের দিকে অগ্রসর হলাম। সঙ্গে কিছু বিস্ফোরকযন্ত্র আর দুটি স্টেনগান। মস্তাননগর এবং মিরসরাইয়ের মাঝামাঝি পুলটায় পিইকে বিস্ফোরক ফিট করলাম। তারপর ওখান থেকে একটা তার এনে দেওয়াগঞ্জের অদূরে একটা ঝোপের আড়ালে দুজনে নিঃশব্দে বসে প্রহর গুনছিলাম কখন আমাদের কাজ সম্পন্ন হবে।
দুজনে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। অন্যদিকে মশার উপদ্রব। কিন্তু সেই মুহূর্তে কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল না। সকাল সাড়ে আটটায় ‘উল্কা’ আসবে, ওটাকে লাইনচ্যুত করতেই হবে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সকাল আটটার দিকে ওরা একটি টেস্টিং গাড়ি পাঠাল। গাড়িটা নিরাপদে চলে গেল। ওরা বুঝল ওরা শত্রুমুক্ত। খুব সাবধানে অপেক্ষা করতে লাগলাম। গাড়ি পুলের ওপর উঠছে। সুইচে টিপ দিলাম। বিকট আওয়াজ হওয়ার আগেই রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে বড় রাস্তা পার হলাম।
ঘটনার পরপরই চারদিক থেকে জায়গাটা ঘিরে ফেলল হানাদাররা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ইঞ্জিনটা ধ্বংস হয়ে ১০-১২ হাত দূরে গিয়ে পড়েছে। গাড়িতে বেশ কিছুসংখ্যক হানাদার পাকসেনা এবং রাজাকার ছিল। চারটা বগিসহ তারা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। মনে মনে আনন্দিত হলাম। সেপ্টেম্বর মাসে বিবিসি আমার এই অপারেশনের খবর প্রচার করেছিল। এই অপারেশনের ফলে আট দিন রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া এবং বিজয়ের আনন্দ আমার জীবনে স্মরণীয়।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। ইতিমধ্যে হানাদার বাহিনী, আলবদর, রাজাকার, মুজাহিদ বাহিনীর দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে। চারদিকে নারীহরণ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, খুন বেড়েই চলছিল। তাদের দৌরাত্ম্যের ফলে আমাদেরও টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজাকার আর মুজাহিদ বাহিনী মিঠানালা ইউনিয়ন বোর্ডে আস্তানা গাড়ল। সেখানে তারা হত্যাযজ্ঞ আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল। নিরীহ জনগণ তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের নিধন করতেই হবে। রাত আড়াইটার দিকে দলবল নিয়ে বোর্ড ঘেরাও করলাম।
বাঁশি বাজিয়ে এলএমজি নিয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। গুলির আওয়াজের মধ্যেই শুনতে পেলাম ঘৃণ্য কুকুর আর হায়েনাদের দালাল রাজাকার-মুজাহিদদের আর্তনাদ। এলএমজির ফায়ার অব্যাহত রাখলাম। কিছুক্ষণ পর সঙ্গীদের ডাকে ফিরে তাকালাম—স্যার, শত্রুরা সব শেষ, ফিরে চলুন। সেদিন সবাই নিহত হয়েছিল কি না জানি না, তবে এরপর সেখানে আর তাদের দৌরাত্ম্য দেখা যায়নি।
আর একটি অপারেশন করেছিলাম দুর্গাপুর হাইস্কুলে। সেখানেও কিছু রাজাকার নিহত হয়েছিল। কিন্তু সেদিন শহীদ হয়েছিল আমার পরম স্নেহের বন্ধু সাথী ফরিদ। তার অসীম সাহস আমার মনে আজও স্মৃতি হয়ে আছে। তাকে চিরদিনের জন্য হারালাম।
ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখে আমাদের থানা মিরসরাই মুক্ত হলো। হানাদাররা পিছু হটল। সেদিনই আমি প্রথম পুলিশ ফাঁড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলাম। থানা থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করলাম। এ সময় আমার দলে প্রায় ১৫০ জন ছেলে যোগ দিল। আমি তখন একটা কোম্পানির অধিনায়ক।
অনেক রক্তের বিনিময়ে গড়া এ বাংলাদেশ। বহু অশ্রুভেজা জননীর লাখো বীর শহীদের প্রাণের বদলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার দলের ফরিদ, লোকমান, সিরাজুল, মোস্তফা, কালাম, বদরুদ্দোজাসহ আরও কত ভাইকে হারিয়েছি। তারা আজ স্বাধীনতার আনন্দে নেই, কিন্তু তাদের কীর্তি চিরদিন অম্লান ভাস্বর থাকবে আমাদের মাঝে। যুগ যুগ ধরে আমরা তাদের স্মরণ করব।
Also Read
-
ডিজিএফআইয়ের চেয়েও ভয়ংকর ছিল র্যাবের গোপন বন্দিশালা
-
নির্বাচিত সরকারই শ্রেষ্ঠ সরকার: মির্জা ফখরুল
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে রাশিয়া, অভিযোগ মার্কিন গোয়েন্দাদের
-
‘ভূতের মুখে রামনাম’: হাছান মাহমুদের বক্তব্য নিয়ে মির্জা ফখরুল