বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীসমাজ

একাত্তরের আগে থেকেই স্বাধিকারের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন শিল্পীরা। আর্ট কলেজের শিল্পীরা রাত জেগে পোস্টার লিখছেন, ১৯৬৯

সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে শুরু হয় নানা টালবাহানা। দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু তাঁর বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অতঃপর আসে ভয়ংকর ২৫ মার্চ। সেই রাতের হত্যাযজ্ঞ আমাদের ঠেলে দেয় মুক্তিযুদ্ধের দিকে।

২৫ মার্চের পরপরই আমি চলে গেলাম জামালপুরে। এদিকে জামালপুরেও শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, লুটপাট, হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের পরিবার চলে আসে শেরপুরে। দিনটি ছিল ২১ এপ্রিল।

জামালপুর থেকে শেরপুর যাওয়ার স্মৃতিটি আজও আমার বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় মৃত্যুর দুয়ার থেকে কীভাবে বেঁচে রইলাম! সেদিন ব্রহ্মপুত্র নদের শেরপুর খেয়াঘাটে এসে দেখি, আমার মতো শত শত লোক নদী পার হওয়ার জন্য ঘাটে উপস্থিত। একটি নৌকায় আমি, নগেন্দ্রনাথ ধর, ধীরেন্দ্রমোহন দে, উত্পলকান্তি ধর, মাসুম আনসারীসহ আরও অনেকে নদী পার হচ্ছিলাম। এমন সময় গুলি করতে করতে দুটি যুদ্ধ বিমান আমাদের দিকে এগোচ্ছিল। দেখেই আমি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সেদিন যুদ্ধ বিমানের গুলি নৌকা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। পরে ঘাটে উঠে দেখি অনেকেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আমার পরিচিত জামালপুরের তারাপদ শীল মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। তারাপদের মেয়েটি পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাতরাচ্ছে। পরে মেয়েটিকে ভারতের তুরা হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সা করানো হয়।

২১ এপ্রিল মধ্যরাতে ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপার থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলি ও মর্টারের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। সে আওয়াজ ক্রমশই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। সমস্ত শেরপুর শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল আতঙ্ক। পরদিন ভোরবেলা আমার পরিবারপরিজন নিয়ে অনেক কষ্ট করে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হই। সেই দিনই প্রায় ১০ হাজার শরণার্থী ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার প্রথম দিনই শরণার্থী ক্যাম্প তৈরি শুরু করে এবং রেশনের ব্যবস্থা করে। প্রায় ২০ দিন ভারতের তুরা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে অবস্থান করে ১৬ মে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, বাংলাদেশের অনেকেই এসেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে যেভাবে পারছেন কাজ করছেন। সন্ধান পেলাম বাংলাদেশ শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতির। সভাপতি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদক। তাঁরা বাংলাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে তাঁদের সংগঠিত করছেন। দীপেন দার কাছ থেকে জানতে পারলাম ১৪৪ লেনিন সরণিতে বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে গানের দল গড়ে তোলা হয়েছে।

সেখানে বাংলাদেশের শিল্পীরা নিয়মিত গানের মহড়া করছেন। লেনিন সরণিতে গিয়ে ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা খাতুনকে পেলাম। ওয়াহিদুল হক আমাদের পূর্বপরিচিত। বললেন, বীরেন, আমাদের সঙ্গে কাজ করুন। শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, স্বপন চৌধুরী ও গোলাম মওলাও আমাদের সঙ্গে আছেন। দেখলাম গানের মহড়া চলছে। শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন স্বপন চৌধুরী, আলোকময় নাহা, রফিকুল ইসলাম, মাহমুদুজ্জামান বেণু, শাহীন মাহমুদ, লায়লা জামান, ফ্লোরা আহমেদ, বিপুল ভট্টচার্যসহ আরও অনেকে। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা আপা।

এই সংগঠন ভারতের বিভিন্ন স্থানে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে গানের অনুষ্ঠান করে তাদের মনোবল চাঙা করে তুলতে সহায়তা করত এবং ভারতীয় জনগণকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলত। আর চিত্রশিল্পীদের কাজ ছিল অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জা ও পেছনের দৃশ্যপট আঁকা। মুস্তাফা মনোয়ারের নির্দেশনায় আমি ও গোলাম মওলা মঞ্চসজ্জা করতাম।

একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন শিল্পী কামরুল হাসান। তিনি বললেন, ‘তুমি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ে যোগদান করো।’ এই প্রস্তাব পেয়ে আমি সেদিন অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। আমি ডিজাইনার হিসেবে মন্ত্রণালয়ের কাজে যোগদান করলাম। কামরুল হাসান পরিচালক; নিতুন কুন্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, নাসির বিশ্বাস ও প্রাণেশ মণ্ডল—এরা সবাই ডিজাইনার। আমরা নিয়মিত কাজ শুরু করলাম। আমার আর গানের স্কোয়াডের সঙ্গে থাকা হলো না। মোট আটজন লোক নিয়ে শুরু হলো তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা শাখা। ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ছিল আমাদের অফিস। সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ছিল অফিসের সময়।

প্রথম দিকে কামরুল হাসান আমাদের সবাইকে নিয়ে বসতেন। কী ধরনের কাজ আমরা করব খোলামেলা আলোচনা করে তিনি তা বুঝিয়ে দিতেন। প্রথম দিকে মনোগ্রাম, পোস্টার, কার্টুন, লিফলেট, ব্যানার নকশা ইত্যাদি করতে হতো। যেকোনো কাজে সবাইকে তিনি দুটি করে নকশা করতে বলতেন। আমরা সবাই নকশা করে কামরুল ভাইয়ের কাছে জমা দিতাম। তিনি সবগুলো নকশা একত্র করে সবাইকে নিয়ে বসে নির্বাচন করতেন। যে নকশাগুলো ভালো হতো সেগুলোকে আরও ভালো করতে বলতেন।

এভাবে কোনো কোনো পোস্টার দুই কিংবা তিনবার পরিবর্তন করার পর চূড়ান্ত হতো। কামরুল হাসান তাঁর ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শীর্ষক পোস্টারটি তিন-চারবার পরিবর্তন করে চূড়ান্ত করেছিলেন। এভাবেই আমরা সবাই মিলে ‘বাংলার হিন্দু বাংলার খৃষ্টান বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’, ‘সদাজাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’, ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’, একেকটি বাংলা অক্ষর অ আ ক খ একেকটি বাঙালির জীবন’, ‘বাংলাদেশের সম্পদ বৃদ্ধি করুন পাকিস্তানী পণ্য বর্জন করুন’, ‘বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক সকলেই আজ মুক্তিযোদ্ধা’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেবো’ শীর্ষক পোস্টারগুলো তৈরি করেছিলাম।

এ রকম অসংখ্য পোস্টার আমরা সবাই মিলে নকশা করেছি। বেশির ভাগ লেটারিং আমি ও প্রাণেশ দা করতাম। ড্রইংপ্রধান নকশাগুলো বেশির ভাগ করতেন প্রাণেশ দা, নাসির ভাই ও নিতুন দা। তত্কালীন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নূরুল ইসলাম ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির অ্যাকটিং পাবলিসিটি কনভেনার ছিলেন। তিনি আমাকে কিছু পোস্টার ও লোগোর কাজ দিয়েছিলেন। আমি ও শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী যৌথভাবে পোস্টার নকশার পরিকল্পনা ও অংকন করি। যেমন ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেব’।

নাসির বিশ্বাস কাজ করতেন বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব আমিনুল ইসলাম বাদশা ও বাদল রহমানের সঙ্গে। নাসির ভাইকে দিয়ে অনেক ড্রইং, পোস্টার, ব্যানার, লোগো করিয়ে নিতেন তাঁরা।

একদিন অফিসে এলেন জহির রায়হান ও আলমগীর কবির। ফিল্মের কিছু কাজ আমাদের করতে হবে। তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমাদের ওপর কিছু দায়িত্ব পড়ল। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ফিল্মের যে কাজগুলো করতেন যেমন—টেলপ, কিছু ড্রইংসহ বেশ কিছু কাজ আমরা ডিজাইন শাখা থেকে করে দিয়েছিলাম। এক দিন হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘একটি লোগো করতে হবে।’ বললাম, ‘রং-তুলি কিছুই নেই, কীভাবে করব?’ হাসনাত ভাই বললেন ‘পকেটে কলম আছে, এটা দিয়েই করে দিন।’ উনি একটি চায়ের দোকানে নিয়ে বসালেন। তখন ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার ছিল। ভেতরে কালি ভরা থাকত। কলম খুলে চায়ের প্লেটে কালি ঢেলে দেশলাইয়ের খোলা দিয়ে ঘষে ঘষে লোগোটি করলাম। লোগোটি কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধর লোগো হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল। এ রকম অনেক কাজ আমরা সবাই মিলে করতাম। কলকাতার অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী যেমন—দীপেন দা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন দা, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন এবং আরও অনেকে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে আমাদের সবার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতেন এবং কলকাতার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়তা প্রদান করতেন।

ক্যানভাস-রং-তুলি-ইজেলসহ অনেক অংকনসামগ্রী মন্ত্রণালয় থেকে আনা হলো। শেখ মুজিবের পোর্ট্রেট করা শুরু হলো। সবাই মিলে ড্রইং করে রং চাপালাম। একটি পর্যায়ে ফাইনাল টাচ দিতেন প্রাণেশ দা, নাসির ভাই ও নিতুন দা। এখানে বেশ কিছু কাজ আমরা করতে থাকলাম। শেখ মুজিবের পোর্ট্রেটগুলো মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। এর একটি পোর্ট্রেট সম্ভবত বাদল রহমানের বাসায় আছে বলে আমার মনে পড়ছে। ছবিটি প্রাণেশ মণ্ডলের আঁকা। এসেই বুঝলাম, কিছু নতুন নতুন কাজ এসেছে। যেমন—শেখ মুজিবের পোর্ট্রেট, পতাকার ডিজাইন, কিছু লোগো—যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, ডাকঘর, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো ইত্যাদি। আমরা সবাই মিলে দুটি-তিনটি করে করতে থাকলাম। তখন অক্টোবর মাস। এসব কাজ দেখে মনে হলো, আমরা হয়তো শিগিগরই স্বাধীনতার দিকে যাচ্ছি।

এল ডিসেম্বর মাস। পাকিস্তানিরা ভারতীয় ভূখণ্ডে আক্রমণ চালাতেই জোর যুদ্ধ বেঁধে গেল। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ কমান্ড গঠিত হলো। সংবাদ আসে, নতুন নতুন এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে যাচ্ছে। আনন্দে আমরা আত্মহারা। স্বাধীন দেশে ফিরে যাব এই আশায় দিন গুনছি। যুদ্ধের শেষ ভাগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালেন। সেই আহ্বান বারবার আকাশ বাণী থেকে প্রচারিত হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর সকালে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে রাজি হলেন। সেদিন বেলা ৪-২১ মিনিটে ঢাকায় তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। নিয়াজির আত্মসমর্পণের পর যুদ্ধ থেমে গেল। বাংলাদেশ মুক্ত এবং স্বাধীন। সে কী জয়ধ্বনি! সে কী আনন্দ। সবাই আনন্দ-উল্লাস করছে, মিষ্টি বিতরণ করছে। স্লোগানে মুখরিত কলকতা নগর ‘জয় বাংলা’, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’।

আমরা তথ্য মন্ত্রণালয়ের চারুকলা বিভাগ গুটিয়ে ফেললাম। সমস্ত রং-তুলি-ক্যানভাস ঢাকায় নিয়ে আসা হলো কামরুল হাসানের বিসিকের অফিসে। স্বাধীনতার পর কামরুল ভাই আমাদের করা লোগোগুলো পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন করিয়ে চূড়ান্ত করে দিলেন। যেমন বাংলাদেশের পতাকা, বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো, ডাকঘরের লোগো ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের এক চিরস্থায়ী অহংকার। সেই যুদ্ধে আমরা শিল্পীসমাজ যোগ দিয়েছিলাম প্রাণের তাগিদ থেকে, এক সুমহান অঙ্গীকার সেদিন আমাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। ইতিহাসের এক গৌরময় কালপর্বে অংশ নিয়েছিলাম আমরাও!

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত