বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর

মায়ের ছবি দেখে

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন

আমার মা শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের এই ছবিটা দেখে অনুভূতি হলো একটু অন্য রকম—মনটা বিষণ্নতায় ভরে গেল। আমি ফিরে গেলাম ১৯৯১ সালে। সে বছর প্রেসক্লাবে আফতাব আহমেদের একটি ছবি প্রদর্শনী চলছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা তাঁর ছবিগুলো। পরে তিনি একটি ছবির অ্যালবামও প্রকাশ করেন ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ শিরোনামে।

মায়ের লাশের ছবি আমি সেই প্রদর্শনীতেই প্রথম দেখতে পাই। মাকে যখন আলবদর বাহিনীর লোকেরা আমার সামনে থেকে চোখ বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে যায়, সেটাই তাঁর শেষ যাওয়া। সেটা ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর দুপুরবেলা। মাকে আর দেখিনি। মা ফিরেও আসেননি। তাঁর কিছু নিদর্শনের ভেতরেই তাঁর অস্তিত্বকে আমি খুঁজে ফিরেছি। ১৯৯১ সালেই আমাদের শহীদ সন্তানদের একটা সংগঠন হয়েছিল প্রজন্ম ’৭১ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তানদের সংগঠন)। এ সংগঠনের ব্যানারে আমরা একটা অনুষ্ঠান করি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক (টিএসসি) মিলনায়তনে। সেখানে আমি এক বক্তাকে আবিষ্কার করি। নাম দেলোয়ার হোসেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, তিনি আমার মাকে দেখেছিলেন এবং মৃত্যুর পূর্বক্ষণে আমার মা কী বলেছিলেন, সে কথাও তিনি বলেছিলেন বক্তৃতায়। এরপরই আমার ভেতরে মাকে নিয়ে কিছু করার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে।

ওঠে। নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে আমার শ্রদ্ধেয় ছোট মামা অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দীনের প্রেরণায় আমরা শুরু করি মায়ের স্মৃতি সংরক্ষণের নানান কার্যক্রম। এর অংশ হিসেবে তাঁকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের কাজও শুরু হয়। বইটি প্রকাশের কাজে হাত দিয়ে জানতে পারি, মায়ের সঙ্গে কারা পরিচিত ছিলেন; কারা তাঁকে চিনতেন, জানতেন, তাঁর সহকর্মী বা সহযোদ্ধা ছিলেন। সবার কাছ থেকে মায়ের সম্পর্কে লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে খুঁজে পাই অনেক ছবি, পরিধেয় বস্ত্র, হাতের রেখার নিদর্শন। একটি স্ট্যাম্পবুক। আমাকে দেওয়া মায়ের কিছু বই। এই স্মারকগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে প্রকাশের আগ মুহূর্তে প্রথম আলোয় একটি ছবি দেখে আমি আঁতকে উঠি। সেখানে ছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে মায়ের লাশ উত্তোলনের ছবিটি। ছুটে যাই প্রথম আলো কার্যালয়ে। যোগাযোগ করি ওই পত্রিকার সাংবাদিক আমার বন্ধু, মিতা জাহীদ রেজা নূরের সঙ্গে। ওঁকে অনুরোধ করি, ২০০৬-এর ১৪ ডিসেম্বর ওই দৈনিকে প্রকাশিত ছবিটি আমাকে দেওয়ার জন্য। ছবিটি তুলেছিলেন ইরানের আলোকচিত্রী মি. আব্বাস, ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে। এ ছবিটি সংযোজন করতেই আমাকে বইয়ের ফর্মা পরিবর্তন করতে হয়। বইটি আমরা ফেব্রুয়ারির মেলায় প্রকাশ করতে পারিনি। বইটি প্রকাশ করি ৮ মার্চ ২০০৭ বিশ্ব নারী দিবসে। বইটি এখন পাওয়া যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

২০০৭ থেকে ২০১৫-এর ডিসেম্বর—ঠিক ৮ বছর পরে ৮ ডিসেম্বর আবারও প্রথম আলো কার্যালয়ে এলাম। তবে এবার আমাকে ডাকা হলো প্রথম আলোর পক্ষ থেকেই। জানানো হলো, আমার মা সেলিনা পারভীনের একটি নতুন ছবি খুঁজে পাওয়া গেছে—রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁর লাশ। ছবিটি তুলেছিলেন ভারতীয় আলোকচিত্রী রবীন সেনগুপ্ত।

এই মর্মান্তিক ছবিটি দেখেই আবার মনে পড়ল দেলোয়ার হোসেনের বলা কথাগুলো। মা মৃত্যুর আগে যা বলেছিলেন, তা আমি শুনেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত কিংবা ১৫ ডিসেম্বর সকাল অবধি ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালি জাতির বিবেক দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, কবি, চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের তালিকা তৈরি করে বাসা থেকে অপহরণ করে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে বন্দী করে নির্যাতন করেছিল আলবদররা। আমার মাকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ওখানেই বন্দী ছিলেন তিনি। তাঁদের সবার চোখ আর হাত বাঁধা ছিল। এই দীর্ঘ সময় তাঁদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এবং শেষ মুহূর্তে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়েছিল। সেই সময় আমার মাসহ সবাই বুঝে ফেলেছিলেন, এই হয়তো তাঁদের জীবনের শেষ মুহূর্ত। মা তখন ওদের অনুনয়-বিনয় করছিলেন তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বলেছিলেন, ‘ঘরে আমার আট বছরের একটা সন্তান আছে, ও না খেয়ে আছে। ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। শুধু এই শিশুটির কথা চিন্তা করে আমাকে ছেড়ে দাও।’

হায়েনারা তাদের বন্দুকের বেয়নেট চার্জ করে মায়ের মুখ ফেঁড়ে দেয়। তিনি তখন আরও জোরে চিৎকার করতে থাকেন। কথা অস্পষ্ট হয়ে যায়, তারপরও যতটুকু বোঝা যায়, তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি আর এই শহরে থাকব না, লেখালেখি করব না। ছেলেকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব।’ তাতেও আলবদর বাহিনীর ওই নরপিশাচদের এতটুকুও করুণা হয়নি, বরং বেয়নেট চার্জ করে এবং গুলি করে মাকে তারা হত্যা করে। মৃত্যু জেনেও যে মা তাঁর সন্তানের কথা ভুলতে পারেননি, সেই মাকে, সেই মায়ের মৃতদেহের স্মৃতি কখনোই মুছে যাবে না আমার অন্তর থেকে। আর তাই ছবিটি দেখেই আমি বুঝে যাই, এই আমার সেই মা। আমি স্থির হয়ে যাই। বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি, কথা বলতে পারি না, আবেগও ধরে রাখতে পারি না। হয়তো এটাই স্বাভাবিক।

বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম করছে, সে জন্য আমাদের শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে তারা ধন্যবাদ পাবে। কিছুদিন আগে আরও দুজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় হয়েছে। এটি ছিল চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের রায়। কিন্তু সে রায় কার্যকর হয়নি, অপরাধী দুজন পলাতক। আমি বলব, এই বিচার কার্যক্রমে আমাদের আংশিক দায়মুক্তি ঘটেছে। সব মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার হলেই কেবল আমরা দায়মুক্ত হতে পারব।

যুদ্ধের পর থেকেই আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বরাবরই চেয়ে এসেছি। শহীদজননী জাহানারা ইমাম থেকে শুরু করে শাহবাগের গণজাগরণ পর্যন্ত পুরো সময়টাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে বেগবান করেছে। এত দিন পর হলেও শেষ পর্যন্ত যে এদের বিচার হচ্ছে, এটাই স্বস্তির। অপরাধীর বিচার না হলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করত না।

মো. সুমন জাহিদ: শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে