বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর

বাংলার স্বশাসন

১০ এপ্রিল ১৯৭১, ঠিক যেদিন বাংলার এক প্রান্তে মুজিবনগর সরকার শপথ নিচ্ছে, সেদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এর ‘লেটারস টু দি এডিটর’ কলামে ‘হোম রুল ফর বেঙ্গল’ শিরোনামে এক প্রতিবাদপত্র প্রকাশিত হয়। লেখকেরা প্রত্যেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্ডিত এবং সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। একবাল আহমদ, যাঁকে গুরু মানতেন ‘ওরিয়েন্টালিজম’ গ্রন্থের লেখক এডওয়ার্ড সাঈদ, তিনি ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস-এ এক পাকিস্তানি কূটনীতিকের জবাবে বাংলাদেশের পক্ষে আবারও কলম ধরেন। আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আইজাজ আহমদ এখন ভারতের নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরির প্রফেসরিয়াল ফেলো। সাগির আহমদ একবাল আহমদের ছোট ভাই। নিউইয়র্ক টাইমস আর্কাইভ থেকে প্রতিবাদপত্রটি অনুবাদ করেছেন ফারুক ওয়াসিফ।

পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানে সংঘবদ্ধভাবে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা এবং সম্পদের নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞকে অপরিহার্য বলে কোনোভাবেই জায়েজ করা যাবে না।

প্রিয় সম্পাদক,

সম্প্রতি আমাদের দেশে যা ঘটছে, পশ্চিম পাকিস্তানি হিসেবে তা নিয়ে আমরা মর্মাহত এবং লজ্জিত। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নাকচ করাকে আমরা নিন্দা জানাই। আমরা ধিক্কার জানাই বাংলার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দমনের চলমান নৃশংস নীতিকে।

যে সংকট চূড়ান্ত দশায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণায় পরিণত হয়েছে, তার শতভাগ দায়দায়িত্ব নিতে হবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদীরা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের গণরায়কে কখনোই মেনে নিতে পারেনি।

পাকিস্তানের ২৩ বছরের জীবত্কালে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক স্বার্থভোগীরা দেশের ঐক্যরক্ষায় বশ্যতা চেয়েছে, সহযোগিতা চায়নি। অংশীদারির পথে না গিয়ে তারা নিয়েছে বলপ্রয়োগের পথ, আপস-সমঝোতার বদলে জবরদস্তির পথ। আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষে বাংলার জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন প্রমাণ করে, তারা তাদের ঔপনিবেশিক দশার অবসান চায়; চায় দেশের দুই অংশের সম্পর্ক নতুন করে নির্ধারণ করতে।

পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা জাতীয় ঐক্যরক্ষায় আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হলে দেয়ালের লিখন তাঁদের নজর এড়াত না। তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের দাবি তাঁরা নাকচ করতে পারতেন না। বদলে তাঁরা বেছে নিয়েছেন সংঘাতের পথ এবং পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এ ছাড়া বাঙালিদের আর কোনো বিকল্প ছিল না।

পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানে সংঘবদ্ধভাবে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা এবং সম্পদের নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞকে অপরিহার্য বলে কোনোভাবেই জায়েজ করা যাবে না। আদতে এটি হচ্ছে বাঙালি জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের মজ্জাগত ঘৃণার প্রকাশ। কেন্দ্রের শাসকদের নির্দেশে যে বর্বরতার সঙ্গে সেনাবাহিনী সেখানে হস্তক্ষেপ করেছে, তাতে পরিষ্কার যে তারা নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসক বৈ অন্য কিছু ভাবে না।

আলবত, বাঙালিদের প্রতিরোধ এত সর্বব্যাপী যে সেখানে দালাল সরকার বসানো সম্ভব হবে না।

আমরা আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইবোনদের প্রতি আবেদন জানাই: ‘ঐক্য’ ও ‘সংহতি’র নামে উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগানে ভেসে যাবেন না। কেননা, বুলেট ও বোমা মেরে ঐক্যরক্ষা হয় না। একটি জনগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রেখে সংহতি অটুট রাখা অসম্ভব।

যদি আমরা নিজেদের মুক্তিস্পৃহাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি, তাহলে অন্যদের স্বাধীনতাস্পৃহাকেও সম্মান করতে হবে।

আমরা জাতিসংঘ এবং বিশ্ব জনমতের কাছে আবেদন জানাই, অবিলম্বে বাঙালিদের ওপর চলমান গণহত্যা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিন। তার জন্য জাতিসংঘের উচিত এখনই সেখানে একটি সত্যানুসন্ধান মিশন এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস দল পাঠানো। এ মুহূর্তে এটাই জরুরি কর্তব্য।

শিকাগো, ১ এপ্রিল ১৯৭১

লেখকেরা পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় নিয়োজিত।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত