বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর

পীরবাড়িতে শহীদে কারবালা

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা

বগুড়া শহর থেকে সাত মাইল উত্তরে ঐতিহাসিক মহাস্থান ও পৌরাণিক বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বলে কথিত গোকুল মোড় এলাকা-সংলগ্ন রামশহর গ্রাম। এই রামশহর গ্রামে ছিলেন উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত পীরপরিবারের আদি পুরুষ পীরে কামেল ডা. কহরউল্লাহ সাহেব। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনে পীরপরিবার বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পীরপরিবারের নিধনযজ্ঞের সহায়ক তদানীন্তন সময়ের দু-একটি রাজনৈতিক ঘটনার উল্লেখ এখানে প্রয়োজন। সত্তরের নির্বাচনে বগুড়া সদরে পিডিবির প্রার্থী ওসমান গনি তার এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় গদিনশিন পীর সাহেব মৌলভি বেলায়েত হোসেনের ভাবমূর্তি ব্যবহার করে হীনস্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় জামায়াতিরাও সত্তরের নির্বাচনে পীরপরিবারকে তাদের দোসর হিসেবে প্রত্যাশা করে ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া পীরপরিবারের তিনজন ছেলে স্বাধীনতাসংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগ দিলে তাদের আক্রোশ তীব্রতর হয় এবং হায়েনার পৈশাচিকতায় প্রতিশোধ নেয়। ঘটনার দিন স্থানীয় রাজাকার ও জামায়াতিরা বোরখা পরিহিত অবস্থায় যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে মাওলানা আবু তাহের ও ওসমান গনি সশরীরে উপস্থিত ছিল।

বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর, বাংলা ১৩৭৮ সনের ২৬ কার্তিক, অতি প্রত্যুষে পীরবাড়ি ও তার আশপাশ এলাকা ঘেরাও করে। বাড়ির মোট সাতজন পুরুষ সদস্য এবং গ্রামের অন্য পাড়ার যাকে যেখান থেকে ধরতে পেরেছে এমন চারজনসহ মোট ১১ জনকে পুকুরপাড়ে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ওই ১১ জন শহীদের মধ্যে ১৪ বছর বয়সী সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এক কিশোর থেকে শুরু ৬৮ বছর বয়সী একজন অসুস্থ বৃদ্ধ পর্যন্ত ছিলেন। উল্লেখ্য, এঁদের সবাইকে ধরা হয়েছিল পবিত্র রমজান মাসের ২৩ তারিখে ঠিক সেহরি খাওয়ার সময়। কেউ সেহরি শেষ করেছেন, আবার কাউকে তাঁর অর্ধসমাপ্ত সেহরি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পীর মো. বেলায়েত হোসেন নরপশুদের কাছে ফজরের নামাজ পড়ার সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান ও ইসলামের রক্ষাকারী খাঁটি ‘মুসলমানেরা’ তাঁদের সে সময় দেয়নি।

১.

আমি মো. তবিবুর রহমান, পীর ডা. কহরউল্লাহর পঞ্চম সন্তান। আমার তখন সেহরি খাওয়া শেষ। বড় ভাই হাবিবুর রহমান সবে দুধ-ভাত মেখে খাওয়া শুরু করবেন, ঠিক তখনই বাড়ির বড় ভাবি (ছলিম উদ্দীন সাহেবের স্ত্রী) হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, বাড়িতে মিলিটারি এসেছে। ধলুকে (তার বড় সন্তান) ধরে ফেলেছে। তোরা পালা। তখন আমি বাড়িতে থাকা কিছুতেই নিরাপদ নয় মনে করে পাচিল টপকে ওপারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। দ্রুত মই বেয়ে পাচিল-সংলগ্ন কলাগাছ ধরে ঝাউ জঙ্গলের মধ্যে নামতেই দুজন পাকিস্তানি সেনা আমাকে লক্ষ্য করে দুদিক থেকে দুটো গুলি করে এবং একজন বলে, ‘ঠাউরে এধার আও।’ আমি তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করলে আরও একটা গুলি করে। সেদিন ঘন কুয়াশা পড়ছিল বলেই হয়তো গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তৃতীয়বার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পর আমি তাড়িতের মতো দৌড়াতে শুরু করি। এ রকমভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর মরিচখেতের বেড়ার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পাশের শুকনো নর্দমার মধ্যে পড়ে গোঙাতে থাকি। এভাবে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। তারপর আবার উঠে চলতে থাকলে বেশ দূর থেকে চতুর্থবার গুলি করা হয়। আমি তখন মৃতপ্রায়, তবুও কোন অদৃশ্য শক্তির সহায়তায় ছোটখাটো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো হাঁটতে হাঁটতে পাকিস্তানি সেনাদের বেষ্টনী পার হয়ে যেতে সক্ষম হই। এভাবে যখন পার্শ্ববর্তী গ্রামে পুরো এক বদনা পানি চেয়ে খেয়ে প্রাণটা বাঁচল মনে করলাম, ঠিক তক্ষুনি ক্যাট ক্যাট গুলির আওয়াজ ভেসে এল কানে। বুঝলাম, রামশহর কারবালায় পরিণত হয়ে গেছে।

২.

আমি আবদুল হান্নান, হাবিবুর রহমানের শ্যালক। তখন আমার বয়স ১৪ এবং সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। সেদিন আমিও সেহরি খেয়ে উঠতেই জানতে পারি পাকিস্তানি মিলিটারি আসার কথা। তবিবুর ভাই পাচিল টপকানোর সময় পরপর তিনটি গুলির শব্দ শোনার পর বাড়ির ভেতর পালানোর জন্য ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় দরজার সামনেই জটলা লক্ষ্য করে একটি গুলি করে ওরা। এই গুলিতে বাড়ির গোলাপি নামের আট-নয় বছরের কাজের মেয়ের পা একেবারে ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রক্তে সে জায়গা ভিজে যায়। তখন কোনো রকমে তাকে ধরে এনে আমার দুলাভাই ও বোন মিলে একটা গামছা দিয়ে পা বেঁধে দেন। গোলাপি গোঙাতে থাকে। গোলাপির পায়ে গুলি লাগায় সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। বিশেষ করে, দুলাভাই হাবিবুর রহমানের মধ্যে মৃত্যুভীতি তীব্রতর হয়ে দেখা যায়। পাচিল টপকে পালানোর জন্য দুজন মিলে ঠেলে তুলে দিলেও তিনি ভয়ে লাফ দিতে পারেননি। ফিরে এসে ঘরের কোঠায় উঠে সেখান থেকেও তিনি নামলেন। পরে মেয়েদের মধ্যে লুকিয়ে বাঁচার জন্য শাড়িও পরেছিলেন। কিন্তু মুখে দাড়ি থাকার কারণে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। শেষে শাড়ি খুলে অজু করে ফজরের নামাজ শেষে সবাই মিলিতভাবে (স্ত্রী ও পুরুষ) তওবার নামাজ শেষ করেন। ততক্ষণে বাড়ির প্রায় সবাইকে ধরে অন্য ঘরের বারান্দায় পেছনে হাত বেঁধে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন সেনা এসে দুলাভাইকে ধরে নিয়ে যায় এবং সবার সঙ্গে বেঁধে রাখে। তখন পার্শ্ববর্তী ধাওয়াকালো গ্রামের আবু সাঈদ নামের আমার সহপাঠী একজন রাজাকারের (রাজাকার আবু সাঈদ বর্তমানে জনতা ব্যাংকে পিয়ন পদে চাকরিরত) সঙ্গে আমি কথা বলি। তখন একজন পাকিস্তানি পশু এসে ছোট্ট একটা অস্ত্র আমার বুকের ওপর ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘জিন্না মান্না কাঁহা হ্যায়।’ আমি চিনি না বলে জানাই। তখন রাজাকার আবু সাঈদ আমার পরিচয় দেয় এভাবে, ‘বোহিনকে বা বাড়ি থাকে।’ সে কথা শুনে আমাকে ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর আমি দেখলাম, সবাইকে বারান্দা থেকে উঠিয়ে বাইরে আনা হচ্ছে। আমি প্রায় পিছু পিছু বাইরে চলে আসি। গোয়ালঘর খুলে একটা গরু বের করার ছল করে দেখতে থাকি। ওরা সবাইকে নিয়ে পুব দিকে মুখ করে পুকুরের পাড়ে বসিয়ে রাখে। তারপর পেছন থেকে প্রথমে মেজো ভাইকে (দবির উদ্দীন, যিনি অসুস্থ ছিলেন এবং সেদিনই পথ্য খেয়েছেন, বয়স ৬৮ বছর) গুলি করে। গুলির শব্দে হাত থেকে ভীতসন্ত্রস্ত গরুও দৌড়ে পালায় আর আমিও সেখানে থাকতে পারিনি। গরুর পেছন পেছন আমি দৌড়ে পালাতে থাকি। তখন ক্যাট ক্যাট করে একনাগাড়ে গুলি হতে থাকে। কিছুদূর ছোটার পর মোজাম পাগলা নামের একজন লোক হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের পালাতে নিষেধ করে বলে, তোরা ফিরে আয়। দ্যাখ, সব শ্যাষ হয়্যা গেছে। ফিরে এসে দেখলাম, ১১টি লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। কারও মাথা চুরমার, ঘিলু বের হয়ে ছিটকে পড়ে গেছে। কারও বুক ঝাঁঝরা, কারও দাঁত-মুখ বিকটভাবে বিকৃত, কারও গলা ও গাল থেকে খাবলা হয়ে মাংস উড়ে গেছে।

৩.

রহিমুদ্দিন চালের ব্যবসা করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৪২-৪৩ বছর। বাড়ি অন্য পাড়ায়। নিরক্ষর। তিনি প্রথম পর্যায়ে গুলি শুনে বাইরে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর নিজের জবানিতে ঘটনাটি এরূপ: প্রথম গুলি শুনে আমি যখন বাইরে এলাম, তখন ভীষণ কুয়াশা। বেশি কিছু ঠাওরানো যাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে মসজিদের দিকে এগোতেই ওদের চলাফেরা দেখে বুঝতে পারলাম, ওরা মিলিটারি। একটু পর আবারও গুলি হতেই আমি সাবধান হয়ে বড় একটা আমগাছের কাণ্ডের ফোকরের মধ্যে বসে থেকে শুধু মাথাটা বের করে পুরো ঘটনাই ওখান থেকে দেখলাম। দেখলাম, ১০-১২ জনকে হাত বাঁধা অবস্থায় পুকুরের পাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে অসুবিধা হওয়ায় আমি গাছ থেকে নেমে ঠিক মসজিদ-সংলগ্ন পানের বরজের মধ্যে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম। ওরা সবাইকে লাইন করে বসিয়ে রেখে পেছন দিক থেকে একেক করে গুলি করে হত্যা করল। গুলি শেষে ওরা আর একমুহূর্ত ওখানে দেরি করেনি। ওই দৃশ্য দেখে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে বের হয়ে আমি প্রথম ছুটে গিয়ে দেখি, একেকজন একেকরকম চেহারা নিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। আমি তখন ওদের বাঁধা হাতগুলো খুলে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজার হাজার লোকের ভিড় জমে গেল সেই শহীদে কারবালা দেখার জন্য।

অনুলিখন: শোয়েব শাহরিয়ার