বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর

চূড়ান্ত লজ্জা

৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরের দিন বীরের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা আসতে থাকেন রাজধানী ঢাকায়। এমনই এক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে সদ্য স্বাধীন বাঙালিরা l ছবি: রঘু রাই (ভারতের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী)

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সূর্য ওঠার ঠিক পরের মুহূর্ত। দ্রুত দেখে নিলাম নিজের নতুন প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান। আমরা বেশ সুসংগঠিত, কিন্তু শত্রুপক্ষের জোরালো আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নই। প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আমাদের সময় দরকার।

খড়ের তৈরি একটি কুঁড়েঘরে স্থাপিত কমান্ড পোস্টে ঢোকার পর ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ শাফির কাছ থেকে আমি একটি টেলিফোন পাই। কোনো ভূমিকা বা অপ্রয়োজনীয় আলাপ না করে তিনি সরাসরি জানালেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল এ এ কে নিয়াজি শত্রুপক্ষের সঙ্গে ‘আপস করতে রাজি হয়েছেন।’ শত্রুতার অবসান ঘটানোর আয়োজন চলছে, আর তাতে অস্ত্র সমর্পণের ব্যাপার রয়েছে। বিস্তারিত জানতে আমি যেন সাদা পতাকা তুলে সমমর্যাদার ভারতীয় বাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি।

অবিশ্বাস্য। নিজেদের এমন পরিস্থিতি আমাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলল। আগে কেউ ব্যাপারটি আমাকে জানাননি। সোজা কথায়, নতুন এই ঘটনাপ্রবাহ আমি বুঝতে পারছিলাম না। এটা নৈতিকভাবে ভুল ও কৌশলগতভাবে অপ্রয়োজনীয়। শত্রুতার ইতি টানার প্রস্তাবের আকস্মিকতা আমাকে এতটাই হতবাক করল যে এর সত্যতা নিয়ে আমার সংশয় হলো। তাই খবরটির উৎস ও প্রেরকের পরিচয় সম্পর্কে ব্রিগেড কমান্ডারকে প্রশ্ন করলাম।

আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। হঠাৎ ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল যে আমাদের রক্ষা করার মতো কোনো দেশ নেই, অর্জন করার মতো কোনো লক্ষ্য নেই, সম্পন্ন করার মতো কোনো অভিযান নেই। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমরা কোনো উদ্দেশ্যপূর্ণ উপায়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নিজস্ব অধিকার হারালাম।

ব্রিগেড সদর দপ্তর থেকে একটি ডাক পেয়ে আমার ঘোর কাটল। অবিলম্বে সৈয়দপুর সেনানিবাসের দিকে পিছু হটার জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হলো। শত্রুপক্ষের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ না হওয়ায় সাদা পতাকা দেখানোর লজ্জা থেকে অন্তত রক্ষা পেলাম।

লজ্জায় মাথা নত করে আমরা সৈয়দপুরে ফিরলাম। পূর্ব পাকিস্তানে নিজ কমান্ডে যোগ দেওয়ার পর এই প্রথমবার আমি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লাম। মন ছিল বিপর্যস্ত। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। পদমর্যাদা ও দায়িত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি এই ‘আত্মসুরক্ষার’ পক্ষে কী যুক্তি দেখাব? যারা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করল, যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিনতম পরিবেশেও অনড়ভাবে দায়িত্বের চেয়েও বেশি কিছু করে দেখাল, তাদের কাছে আমার জবাব কী হবে?

ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম, দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে সেনাদের সামনে বক্তব্য দেব। একটি ফাঁকা জায়গায় সব ইউনিট এসে সমবেত হলো। কথা বলার জন্য আমি তাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। পরিস্থিতি মোকাবিলায় যত্নবান হওয়া প্রয়োজন ছিল। আমাদের নতুন অবস্থান সম্পর্কে সমবেত সেনাদের সুকৌশলে বোঝানোর দরকার পড়ল। শুরু করলাম ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রথম দিনগুলো, তৎকালীন পরিস্থিতি, পদমর্যাদা অনুযায়ী পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমার অভিজ্ঞতার তৎকালীন ঘাটতি এবং সামলে নেওয়ার ঘটনাগুলোর কথা বলে। যুদ্ধক্ষেত্রের সবখানে আমরা যেসব বাধার মুখোমুখি হয়েছি, ঢাকার বাইরে ভারতীয় প্যারাট্রুপারদের অবতরণ, অন্যান্য এলাকায় সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে ভাঙন প্রভৃতি বিষয়ে বললাম। অনিশ্চিত সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের একটি ধারণা দিলাম। তারপর সময় এল আসল অবস্থা সম্পর্কে বলার, আমরা শিগগিরই যার মুখোমুখি হতে চলেছি। আমি বললাম, ‘সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই আমি দুটি পছন্দের ওপর জোর দিয়েছি। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিতে হবে অথবা বঙ্গোপসাগরে ভেসে যেতে হবে। তবে এখন তৃতীয় একটি পছন্দ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর তা হলো আত্মসমর্পণ করা। একজন যোদ্ধার জন্য এবং একজন মানুষের জন্য এটাই চূড়ান্ত লজ্জা।’ এটা ছিল একটা বিধ্বস্ত অবস্থা-আত্মধ্বংসের মুহূর্ত।

কথা বলার সময় নিজের অশ্রু গোপন করার জন্য আমি দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার গলার কাঁপন থামানোর উপায় ছিল না। আমার মনে হলো, একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে আমাদের পরিচয় ধরে রাখার জন্য সবাইকে আমার সঙ্গে রাখতে হবে। আমাকে তাদের মুখোমুখি হতে হবে, যাতে আবেগের সংযোগ গড়ে ওঠে, পারস্পরিক আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। আমি তাদের দিকে তাকালাম প্রতিক্রিয়া যাচাই করার জন্য। তারা সবাই কার্যত নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। অসীম লজ্জা ও অপমান থেকে পালানোর জন্য তারা যেন মাটির গভীরে চলে যেতে চাইছে। অথবা হয়তো নিজেদের অধিনায়কের এমন ভেঙে পড়া অবস্থা না দেখার জন্য তারা ইচ্ছা করেই অমন করছিল। আমি এ কথা বলে দ্রুত বক্তব্য শেষ করলাম যে, যেহেতু জীবিত অথবা মৃত কোনো অবস্থাতেই নেপালে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, অথবা খালি হাতে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করেও ভালো কিছু পাওয়ার আশা নেই, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের নির্দেশ পালন করাই এখন ‘বিচক্ষণতা’ হবে।

যারা মুক্তির জন্য চলে যেতে চায়, তাদের জন্যও দরজা খোলা রাখলাম। টাকাপয়সা দিয়ে সহায়তার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হলো। বেশ কয়েকজন পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তাদের আবেদন মঞ্জুর করা হলো। তাদের কেউ কেউ প্রাণ হারাল। বাকিরা ইউনিটে ফিরে এল, কয়েকজন বুলেটের গুরুতর জখম নিয়ে।

আমাদের পেশাগত মৃত্যুর শেষ আনুষ্ঠানিকতাগুলো কয়েক দিন পর সম্পন্ন করা হলো। লজ্জাজনক কাজটি দলগত হওয়ায় আত্মসমর্পণের প্রভাব ছিল কিছুটা অনুভূতিশূন্য। কিন্তু মাথা হেঁট করে দেওয়া এই অসৈনিকোচিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছিল অসম্ভব বিপর্যয়কর। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন বিলিয়ে দিয়ে অমরত্ব অর্জন করার জন্য প্রকৃতি আমাদের একটি সুযোগ দিয়েছিল, অস্ত্র সমর্পণ করে নয়। কিন্তু আমরা গৌরব বরণ না করার পথ বেছে নিয়েছিলাম।

নিজেদের জন্য যে অবমাননা আমরা বেছে নিয়েছি, মন থেকে তা মেনে নেওয়ার চেষ্টায় চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে আমি বিশ্রামহীন রাত কাটালাম। সেদিন আমরা আমাদের অস্থায়ী নিবাস থেকে বেরিয়ে এলাম এবং মৃত্যুক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। জায়গাটির নাম জাম জাম বিমানঘাঁটি, যুদ্ধের আগে সৈয়দপুরের সেনারা নিজেদের উদ্যোগে নির্মাণ করেছিল। সেটা ছিল এক দীর্ঘ যাত্রা। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম—প্রতিরক্ষাহীন ও অরক্ষিত; যেন একজন কয়েদি ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে জল্লাদের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। দুপুরের মধ্যেই আমরা সবাই জড়ো হলাম সেই বিমানক্ষেত্রে। ২৩ ব্রিগেডের কমান্ডের অধীনে কয়েক হাজার মানুষ, যারা ভিন্ন ভিন্ন আর্মস ও সার্ভিসের অধীন ছিল, তাদের মধ্যে ইপিসিএএফও ছিল। ২৬ এফএফ ছিল ওই সমাবেশের একটি অংশ। আমরা কাছাকাছি দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালাম, প্রত্যেকে নিজের নিজের ভাবনায় তলিয়ে রইলাম।

ব্রিগেড কমান্ডার এসে হাজির। বিজয়ীরাও এল। তারপর যা ঘটল, তা এতটাই অমর্যাদাকর, যে কেউই মন থেকে মুছে ফেলতে চাইবে। কিন্তু সেই অসম্মানজনক স্মৃতি অবচেতন মন থেকে চিরতরে সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। মাঝেমধ্যেই স্মৃতির সমুদ্র থেকে সেসব দৃশ্য ভেসে ওঠে।

আমার মনে আছে, সবাই অধিনায়কের নেতৃত্বে একটি নিয়মিত বিন্যাসে দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি নিজের পিস্তল আনলোড করে সেটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করলেন। সেটা ছিল এক বেদনাদায়ক দৃশ্য—একজন সেনানায়ক জীবনে বহু গৌরবময় পর্ব পেরিয়ে এসে জনসমক্ষে নিজের অহংকার ও স্বাধীনতা বিসর্জন দিচ্ছেন। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তাঁর ভেতরটা চৌচির হয়ে যাচ্ছে, যদিও তিনি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিলেন। তারপর সেনাদের অস্ত্র নামিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পালা। ব্যাটালিয়ানের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার হিসেবে এই অনিবার্য দায়িত্বটি আমার কাঁধেই এসে পড়ল।

আমি আকস্মিক নির্দেশ দিলাম, ‘জমিন ফাং’ (অস্ত্র নিচে রাখো)। প্রত্যেকে যার যার অস্ত্র নামিয়ে রাখল। এরপর কিছুক্ষণের নীরবতা। মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা বুঝি থেমে গেছে। ভারতীয় প্রতিনিধি কী বক্তব্য দিয়েছিলেন, আমার মনে নেই। আমার মনে হয় না, তিনি সে রকম কিছু বলেছিলেন। এটা ছিল সীমিত সময়ের অনুষ্ঠান, সম্ভবত মাত্র কয়েক মিনিটের। কিন্তু মানসিকভাবে পরাজিতদের জন্য তা ছিল সহিষ্ণুতার এক অন্তহীন পরীক্ষা। মুক্ত জীবন থেকে দাসত্বের দিকে যাত্রা, যদিও তাতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লেগেছিল। কিন্তু সেটা ছিল কলঙ্কের এক অন্তহীন পথ।

যেভাবে আমরা নীরবে সমবেত হয়েছিলাম, সেভাবেই নিজেদের অবস্থানবিন্যাস ভাঙলাম। এই গভীর বেদনাদায়ক ঘটনাটির দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কেই প্রকাশ্যে কাঁদল। কেউ শূন্যতাভরা হাসির মধ্য দিয়ে নিজেদের অনুভূতি লুকানোর চেষ্টা করল এবং কারণ ছাড়াই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগল। আর কেউ কেউ নিজেদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে দুঃখ করল এবং এই অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে পড়ার জন্য নিজেদের জ্যেষ্ঠদের দায়ী করতে লাগল। সবাই অপমানিত বোধ করছিল।

যেকোনো পরিস্থিতিতেই আত্মসমর্পণ একটা অসম্মানজনক ব্যাপার। আমাদের ক্ষেত্রে তা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে নাকি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের স্থানীয় সিদ্ধান্তে ব্যাপারটা ঘটেছিল, তা বিবেচ্য নয়। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো লড়াই ছেড়ে দেওয়া অপমানজনক। আমরা হয়তো এই নিন্দনীয় কাজটির পক্ষে এ সাফাই গাইতে পারি, ‘লড়াই করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল না’ বা ‘হাজারো জীবন রক্ষা পেয়েছে’ কিংবা ‘ওই যুদ্ধে সাফল্যময় উপসংহার টানা অসম্ভব ছিল’ ইত্যাদি বলে। কিন্তু এসব যুক্তি মোটেও জোরালো নয়। দৃশ্যত, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের ইতিহাস-চেতনার ঘাটতি ছিল। আমরা যদি লড়াই করতে করতে মারা যেতাম, অথবা সব ধরনের প্রতিরোধের চেষ্টা করার পর বন্দী হতাম, জাতির মাথা উঁচুতে থাকত। পরবর্তী প্রজন্মের সামনে আমরা একটা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে যেতে পারতাম। হাই কমান্ড যদি বুঝতে পারত, এ ধরনের স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত পদক্ষেপ নেওয়ার পরিণাম গোটা জাতির মনোবলের ওপর কী রকম লজ্জাজনক আঘাত হানবে এবং আমাদের চিরশত্রুদের কী পরিমাণ নৈতিক প্রভুত্ব অর্জনের সুযোগ এনে দেবে, তা হলে নিশ্চিতভাবেই জাতীয় মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে ‘কয়েক হাজার জীবন উৎসর্গ’ করার সিদ্ধান্ত নিত।

হাকিম আরশাদ কোরেশীর দ্য ১৯৭১ ইন্ডো-পাক ওয়ার: আ সোলজার্স নেরেটিভ বই থেকে আশিস আচার্যের অনুবাদ

হাকিম আরশাদ কোরেশী: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর ২৮ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের অধিনায়ক

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত