বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর
একাত্তরের রণাঙ্গনে একজন বিহারি মুক্তিযোদ্ধা
একাত্তরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমি ইপিআর বাহিনীতে কর্মরত ছিলাম। আমার কোম্পানি তখন কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ছিল। ২৬ মার্চ আমার কোম্পানির সদস্যরা ক্যাপ্টেন নওয়াজীর নেতৃত্বে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। সে সময় অবাঙালি হিসেবে সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছিল। অর্থাত্ আমি এখন কী করব। কেউ কেউ আমাকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমার মধ্যে এ দেশের মায়া খুবই কাজ করতে থাকে। আমি আমার কোম্পানির অন্য সদস্যদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের কোম্পানি কাউনিয়া ব্রিজের অপর প্রান্তে অবস্থান নেয়। সে সময় কাউনিয়ায় জিআরপি থানা ছিল। সেখানে পাকিস্তানিরা ছিল। আমরা প্রথমে তাদেরই টার্গেট করি। ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে আমরা ব্রিজের অপর প্রান্তে অবস্থান নিয়েছিলাম, ওরা বুঝতে পারেনি।
এ সময় এক পাকিস্তানি মেজর ও তিনজন সিপাহি এবং একজন বাঙালি ওসি ব্রিজ পার হয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে আসছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাঙালি অফিসারটিই সামনে ছিলেন। সে সময় ব্রাশ ফায়ার করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না।
কিন্তু তা করলে বাঙালি অফিসারটির বাঁচার কোনো উপায় নেই। এদিকে তাঁকে রক্ষার জন্য যদি আক্রমণ না করি, তাহলে তারা আমাদের অবস্থানের খবর পেয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, দেশের স্বার্থে হতভাগ্য বাঙালি অফিসারটির জীবন অবসানই মঙ্গলজনক। ব্রাশ ফায়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকেই। পাক জোয়ানদের সঙ্গেই মারা পড়লেন বাঙালি অফিসারটিও। কাউনিয়া ব্রিজের অপারেশন দিয়েই শুরু হলো আমাদের যুদ্ধ।
এর পরই পাকবাহিনীর লোকেরা টের পেয়ে যায় যে তাদের খুব কাছেই আমরা অবস্থান নিয়ে আছি। তারা গুলি চালাতে শুরু করল। আমরাও এবার থেকে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে গেলাম। পাকসেনারা খুব চেষ্টা করে ব্রিজ পার হওয়ার জন্য, কিন্তু কিছুতেই আমরা সে সুযোগ দিয়নি। সেদিন এই ব্রিজ পার হওয়া পাকবাহিনীর জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথম সম্মুখযুদ্ধে আমরা তাদের সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হই।
এদিকে পাকবাহিনী কিছুতেই ব্রিজ পার না হতে পেরে বিকল্প বুদ্ধি আঁটে। তারা প্লেনে করে আমাদের তিন-চার কিলোমিটার পেছনে মহেন্দ্রনগরে আসে। আমরা গোপন সূত্রে সে খবর পেয়ে যাই যে পাকসেনারা পেছন দিক থেকে আমাদের আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে। সে সময় আমরা দ্রুত সেখান থেকে রাজাহাট হয়ে কুড়িগ্রাম চলে আসি। এ সময় আমাদের কোম্পানিতে ইপিআর ও কিছু মুক্তিসেনা মিলে প্রায় ৬০ জন সদস্য ছিল।
কুড়িগ্রামে তিন জায়গায় আমরা ডিফেন্স নিই। তিন জায়গাতেই লড়াই হয়। পাকসেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে চলে যায়। পরের দিন আবার এসে আক্রমণ চালায়। সেখানে এভাবে আমরা তাদের মোকাবিলা করতে পারছিলাম না। আমাদের কাছে ভারী কোনো অস্ত্র ছিল না। বাধ্য হয়ে আমরা নদী পার হয়ে পাটেশ্বরী চলে এলাম। এর পর ভূরুঙ্গামারী হাইস্কুল ক্যাম্পে এসে উঠি। সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা। সেখান আমাদের সঙ্গে একপর্যায়ে এক কোম্পানি ভারতীয় সেনা এসে যোগ দেয়। আমরা খবর পাই হাতিবান্ধা থানায় পাঞ্জাবিরা ডিফেন্স নিয়ে আছে। আমি ৪০ জন সেনাসদস্য নিয়ে ফায়ার করতে করতে এগোতে থাকি।
একই সঙ্গে ভারতীয় সেনারা ওপর থেকে সিলিং করতে থাকে। আমরা যখন শত্রুদের কাছাকাছি চলে যাই, ভারতীয় সেনারা সিলিং বন্ধ করে এবং আমরা ফায়ার শুরু করি। এ সময় পাঞ্জাবিরা সিলিং শুরু করে দিল। এতে আমাদের বরিশালের একজন নায়েক সুবেদার সেখানে শহীদ হন। একপর্যায়ে পাঞ্জাবিরা পাশের একটা নালা ধরে পেছনে সরে যায়। ওই অপারেশনে কোনো পাঞ্জাবি মারা গেছে কি না, আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু পরে আমরা সেখানে গিয়ে অনেক রক্ত দেখতে পেয়েছি। আমাদের ধারণা, সেখানে অনেক হতাহত হয়েছে। তারা তাদের (আহত-নিহত) সরিয়ে নিয়ে যায়।
আমরা রংপুরের হারাগাছা এলাকায় থাকতেই দেশ স্বাধীন হয়। দুটি অপারেশনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য আমাকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।
বি. দ্র. সৈয়দ খানের বয়স এখন প্রায় ৮২। এখন তিনি অনেক কিছুই ঠিকমতো মনে করতে পারেন না। গুছিয়ে বলতেও পারেন না। তাছাড়া যুদ্ধের পর তাঁর ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর স্ত্রী ও সন্তানসন্ততিদের হত্যা করেছিল। তিনি যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে পরিবারের আর কাউকে পাননি। এ অবস্থায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হলেও আর্থিক অনটনের কারণে সেই স্ত্রীও তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে চলে গেছেন। এখন তিনি পরিণত বয়সে একেবারে অসহায় অবস্থায় অন্যের আশ্রয়ে রয়েছেন। এ অবস্থায় তাঁর স্মৃতি থেকে যতটুকু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তা পত্রস্থ করা হলো।
অনুলিখন: আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী অফিস
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত
Also Read
-
মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো কবে নিজ অর্থ নিতে পারবে, জানতে চেয়েছেন লু
-
নতুন করে রিজার্ভ চুরি হয়নি: বাংলাদেশ ব্যাংক
-
সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এলিস মুনরো আর নেই
-
‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন মেরিনা, পিতার নাম ছাড়াই সব সুবিধা পাবেন তিনি
-
‘সন্তান দুনিয়াতে আসবে, দেখতে পাব কি না, জানতাম না’