বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর
উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম যুদ্ধজয়
সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ গ্রামে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। এটি সবচেয়ে স্মরণীয় এবং উত্তরবঙ্গের মধ্যে সর্ববৃহত্ যুদ্ধ। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার। আগের রাতে আমাদের ছয় ব্যাটেলিয়ান মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান ছিল নওগাঁ গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে উল্লাপাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল প্রতাপ নামক গ্রামে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মধ্যরাতের পর আমরা সবাই নৌকাযোগে প্রতাপ গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নওগাঁ গ্রামের ঐতিহাসিক জিন্দানী (র.) মাজারের উত্তর পাশের হাটে চলে আসি। এদিকে রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে আমাদের খবর পৌঁছে গেছে। এদিকে পাশের গ্রামের আমাদেরই সাহায্যকারী যোদ্ধা হাজি আব্দুস সাত্তার নামাজ পড়ার জন্য উঠে অনেক পাকিস্তানি সেনা দেখে একটি চিরকুট লেখে লোকমারফত তড়িঘড়ি করে আমাদের কাছে পাঠান।
চিরকুটটি পড়া শেষ হতে না হতেই মাজারের পাশ থেকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনতে পাই। তাত্ক্ষণিক আমি গুলি করার নির্দেশ দিলে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। প্রচণ্ড গুলির শব্দে নওগাঁ গ্রাম ও বাজার প্রকম্পিত হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা পুকুরের পাড়, জমির আইল ও গাছের আড়াল থেকে গুলি করতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা ধানখেতের মধ্য থেকে মর্টারের শেল আর মেশিনগানের গুলি ছুড়তে থাকে। মাঝে মাঝে কয়েক সেকেন্ডের জন্য গুলি বন্ধ হলে পাকিস্তানি সেনারা ‘ইয়া আলী’ ধ্বনি দিতে শুরু করে। তখন আমরা জয়বাংলা ধ্বনি দিতে শুরু করি। শত্রুপক্ষ এতটাই কাছে চলে আসে যে তাদের ভারী অস্ত্রের কাছে আমরা একেবারে অসহায় হয়ে পড়ি। তারপরও দৃঢ় মনোবল নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাই। আমি একটি এসএমজি নিয়ে গুলি ছুড়তে গেলে আকস্মিকভাবে গুলি আটকে বন্ধ হয়ে যায়। তাত্ক্ষণিক পাশের আরেকজনের কাছ থেকে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে গুলি করতে থাকি। থ্রি নট থ্রি রাইফেল আমার প্রিয়। লতিফ ভাই পাগলের মতো মর্টারশেল নিক্ষেপ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের যোদ্ধারা একটা টু ইঞ্চি মর্টার দিয়ে শেল নিক্ষেপ শুরু করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমাদের ছোড়া একটি শেলও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারে দুটো করে ব্যারেল আর আমাদের রয়েছে মাত্র একটি করে ব্যারেল। একটি করে শেল নিক্ষেপ করার পর ঠান্ডা করে আবার একটি নিক্ষেপ করতে হচ্ছে। কিন্তু তাদের সব মর্টার শেল পুকুর ও নদীর পানির মধ্যে পড়ছে। আমরা সবাই প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছি।
সকাল ১০টা বেজে গেছে। সবাই যার যার অবস্থান থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কোনো ফলই আসছে না। ভোরে যারা বুট পায়ে জমির মধ্যে গেছে, তারাও আটকে পড়েছে। পা দেবে গিয়ে যখন ওরা গুলি করা বন্ধ করছে, তখন আমাদের যোদ্ধারা গুলি করে করে তাদের হত্যা করছে। এই সুযোগটাই আমাদের জন্য সাপে বর হয়ে উঠেছে। এবার তারা প্লেন অ্যাটাকের জন্য খবর পাঠায়। হঠাত্ আকাশে প্লেনের শব্দ শুনতে পেয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। কারণ প্লেন অ্যাটাক হলে আমাদের আর রক্ষা নেই। পরে আমরা জানতে পেরেছি, পাকিস্তানি সেনারা নওগাঁর কথা বলায় পাইলটরা সিরাজগঞ্জের নওগাঁ গ্রামে বোমা না ফেলে নওগাঁ জেলায় ফেলেছে। অলৌকিকভাবে আমরা সবাই বেঁচে গেলাম।
পাকিস্তানি সেনাদের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ল। মাঝেমধ্যে একটা-দুইটা গুলি করছে তারা। আমরা মাঝেমধ্যে ব্রাশফায়ার করে শত্রুদের হতাহত করতে সক্ষম হচ্ছি। অনেক সেনা আহত হয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে। প্রথমেই নয় বেলুচ সেনাকে আত্মসমর্পণ করাই। গ্রামের লোকজনও সেনা ধরে আমাদের কাছে জমা দেয়। কিছু সেনা পিছু হটে আহতদের নিয়ে উল্লাপাড়ার ক্যাম্পের দিকে চলে যায়। আহত ব্যক্তিরা মৃত্যুবরণ করলে ম্যাটিনিটি হাসপাতালের কাছে তারা মাটি চাপা দেয়।
পরে ক্যাপ্টেন সেলিমসহ আরও নয়জনকে আমরা জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলি। গ্রামের লোকজন এলাকার প্রায় ৫০-৬০ জন রাজাকারকে ধরে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা নিহত সেনাদের লাশের সঙ্গে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আটক পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে আমরা নওগাঁ থেকে চাটমোহরের দিকে চলে যাই। যাওয়ার পথে একজনকে রেখে সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক অভিযান শুরু করে নওগাঁসহ আশপাশের গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আমরা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ি। কিছু ভারতে চলে যাই। এই যুদ্ধে দুই কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা অংশ নেয়। তাদের মধ্যে এক কোম্পানি সেনা নিহত হলেও একজন মুক্তিযোদ্ধাও নিহত বা আহত হয়নি। এখান থেকে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়।
অনুকূল প্রকৃতি, আমাদের সাহস এবং পাকিস্তানি সেনাদের ভুল আমাদের জয়কে নিশ্চিত করে।
অনুলিখন: এনামুল হক খোকন, সিরাজগঞ্জ
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে