জনপদের যুদ্ধ

নির্মমতার সাক্ষী পীরবাড়ি

২৩ রমজানের রাত। গ্রামবাসীর সঙ্গে পীরবাড়িতেও সাহ্‌রির প্রস্তুতি চলছিল। বাড়ির নারীরা সাহ্‌রি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় পুরো গ্রাম ঘেরাও করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পীরবাড়ি আক্রমণ করে ৭ সদস্য ছাড়াও প্রতিবেশী আরও চারজনকে ধরে নিয়ে একসঙ্গে পুকুরপাড়ে বসিয়ে ব্রাশফায়ার করে।

পীরবাড়ির সামনে ফলকে স্মৃতি হয়ে আছে ১১ শহীদের নাম

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে রামশহর গ্রাম। ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় বা পুন্ড্রনগরের কোলের এই গ্রামের খ্যাতি ‘পীরবাড়ি’র সুবাদে। পীরবাড়ির বড়পীর ছিলেন পীর এ কেবলা কহরউল্লাহ। তিনি ছিলেন মোজাদ্দেদিয়া তরিকাপন্থী সুফি সাধক। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ছাড়াও বিখ্যাত মানুষের যাতায়াত ছিল রামশহরের পীরবাড়িতে। লাখো ভক্ত, মুরিদ, আশেকান ছিল রামশহরের পীরের। তবে সবকিছু ছাপিয়ে পীরবাড়ির পরিচিতি এখন ১৯৭১–এর বেদনাবিধুর একটি হত্যাযজ্ঞের কারণে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বর্বর হামলা চালিয়ে পীর পরিবারের ৭ জন, প্রতিবেশী আরও ৪ জনসহ মোট ১১ জনকে স্থানীয় একটি পুকুরপাড়ে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এখন পীরবাড়ির সামনে ফলকে স্মৃতি হয়ে আছে ১১ শহীদের নাম।

১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর পীরবাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ হন পীরবাড়ির ছেলে ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত পতিসর রথীন্দ্রনাথ বিদ্যানিকেতনের শিক্ষক শহীদ দবির উদ্দিন, তাঁর ছোট ভাই পীর এ কামেল বেলায়েত হোসেন, আরেক ভাই হাবিবর রহমান, তাঁদের বড় ভাই হাজি ছলিমউদ্দিনের ছেলে খলিলুর রহমান ধলু, খলিলুরের ভাই আবদুস সালাম লালু, বেলায়েত হোসেনের ছেলে ও গোকুল উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র জাহিদুর রহমান মুকুল। পীর পরিবারের আত্মীয় মুন্সি আজগর আলী বেড়াতে এসেছিলেন পীরবাড়িতে। তিনিও রক্ষা পাননি। এ ছাড়া প্রতিবেশী কৃষক ও দিনমজুর হায়দার আলী, মজিবর রহমান, মফছের আলী ও ভুলু মিয়া শহীদ হন।

শহীদ দবির উদ্দিনের নাতি কবি ও প্রাবন্ধিক শোয়েব শাহরিয়ার বলেন, ‘পীরবাড়িতে আমার জন্ম, সেখানেই শৈশব কেটেছে। মুক্তিযুদ্ধে পীরবাড়ি থেকে আমিসহ তিনজন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করি। অন্য দুজন হলেন আমার ছোট মামা মোকছুদুর রহমান এবং জিল্লুর রহমান।’ পীরবাড়ি পাকিস্তানিদের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে শোয়েব শাহরিয়ার বলেন, ‘পীরবাড়ির তিন সদস্যের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের খবর পৌঁছে যায় রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বগুড়া ক্যাম্পে। রামশহর পীরবাড়ির মুক্তিযুদ্ধে সপক্ষে ভূমিকার কথাও তারা জানতে পারে। এরপর ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর পবিত্র রমজান মাসের রাতে পীরবাড়ি আক্রমণ করে ৭ সদস্য ছাড়াও প্রতিবেশী আরও চারজনকে ধরে নিয়ে একসঙ্গে পুকুরপাড়ে বসিয়ে ব্রাশফায়ার করে।’

সেই রাতের নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা মনে হলে এখনো শিউরে ওঠেন শহীদ পীর এ কেবলা বেলায়েত হোসেনের ছোট ছেলে মো. ওবায়দুর রহমান। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে পীরবাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা। পীরবাড়ির তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধে যাতায়াত ছিল পীরবাড়িতে। রাজাকাররা সেই খবর পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্পে পৌঁছে দিলে তারা পীরবাড়ি আক্রমণ করে। কিন্তু সেদিন বাড়িতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। পাকিস্তানি বাহিনী মধ্যরাতে পীরবাড়িতে ঢুকে পুরুষ সদস্যদের ঘর থেকে বের করে হাত বেঁধে ফেলে। বাড়ির নারীদের কাছে এ সময় জানতে চাওয়া হয়, মুক্তিযোদ্ধারা কোথায়? কোনো সদুত্তর না পেয়ে পরিবারের ৭ সদস্যকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়। অন্যরা কোনোরকমে পালিয়ে রক্ষা পান।

সে সময় পীরবাড়ির ছোট সন্তান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোকছুদুর রহমান। একসঙ্গে পরিবারের সাত সদস্যকে হারানোর বেদনা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁকে। তিনি বলেন, ‘২৩ রমজানের রাত। গ্রামবাসীর সঙ্গে পীরবাড়িতেও সাহ্‌রির প্রস্তুতি চলছিল। বাড়ির নারীরা সাহ্‌রি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় পুরো গ্রাম ঘেরাও করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।’ তিনি বলেন, পীরবাড়ি থেকে সাত সদস্যকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাইরে নেয়। শেষ ইচ্ছা হিসেবে পীর এ কেবলা বেলায়েত হোসেন ফজরের নামাজ পড়তে চেয়েছিলেন। বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর শেষ ইচ্ছাটুকুও পূরণ করেনি।

মোকছুদুর রহমান খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই বলেন, ‘যেনতেনভাবে মারা যাওয়া এক জিনিস, আর একই পরিবারের এতগুলো মানুষ শহীদ হওয়া আরেক জিনিস। সরকারিভাবে এই গণহত্যার ইতিহাস সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বছরের বিশেষ দিনেও পীরবাড়ির শহীদদের স্মরণ করা হয় না।’