অপারেশন জ্যাকপট-১৬ আগস্ট
সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর অজানা বীরত্বগাথা
ভাইস অ্যাডমিরাল মিহির কে রায় ১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। তিনিই মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডো গঠনের পরিকল্পনা করেন। তাঁর লেখা ওয়ার ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওশান গ্রন্থের একটি পর্বে তিনি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে নৌকমান্ডো গঠন ও তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন। এর নির্বাচিত অংশ নিচে তুলে ধরা হলো। রচনাটি ২৬ মার্চ ১৯৯৭ তারিখে ভোরের কাগজে–এ প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী স্থলভিত্তিক মুক্তিবাহিনী ছাড়া জলপথে যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, সেসব বাঙালি গেরিলাকে মুক্তিবাহিনীর অন্য যোদ্ধাদের থেকে আলাদাভাবে পরিচয় করানোর প্রয়োজন আছে। কেননা, তাঁদের বীরত্বের কাহিনি অকথিত। তাঁদের নাম দেওয়া চলে ফ্রগমেন।
সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানত নদী অঞ্চলগুলোতে তৎপর ছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম, চালনা, মোংলা ও খুলনা সমুদ্রবন্দরগুলো নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া, যাতে পাকিস্তানের পূর্ব অংশে সামরিক সরবরাহ আসতে না পারে।
অভ্যন্তরীণ নদীপথে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করাও ছিল তাঁদের আরেকটি প্রধান লক্ষ্য। তাঁদের আরও একটা লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানি বাহিনী যেন সমুদ্রপথে পালিয়ে যেতে না পারে।
সাঁতারু মুক্তিবাহিনী শারীরিক-মানসিক দুই দিক থেকেই ছিল দুর্ধর্ষ। সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধারা যেসব অঞ্চলে অভিযান চালাতেন, সেগুলোর ভূগোল থাকত তাঁদের নখদর্পণে। তাঁরা খুব অল্প অস্ত্রশস্ত্র বহন করতেন। ফলে সহজেই তাঁরা লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন। চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন জোয়ার অথবা ভাটার, পূর্ণিমা অথবা অমাবস্যার।
জলের নিচে শ্বাস নেওয়ার জন্য কোনো উন্নত যন্ত্র তাঁদের ছিল না। এ কাজে ব্যবহার করতেন বাঁশের ও পেঁপে পাতার চোঙা। তাঁদের বিশেষ কোনো পোশাক ছিল না। লুঙ্গি আর বেনিয়ান পরেই অভিযানে যেতেন।
সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধাদের মূল অংশটি গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানি তৃতীয় দাফনি সাবমেরিন ‘মানগ্রো’ থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি নাবিকদের একটা অংশকে ঘিরে । তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন আরও এক ডজন বাঙালি নাবিক, যাঁরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন।
এ ছাড়া আরও তিনজন ব্যবসায়ী নাবিক, যাঁরা ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামের লোক ছিলেন, তাঁরাও ওই দলে ভিড়ে যান। এভাবে বাঙালি সিম্যান মিলে গড়ে তোলেন মুক্তিবাহিনী ফ্রগমেন বা সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় অংশটি।
পরে এতে যোগ দেওয়াদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের তরুণ ছাত্র এবং চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার তরুণ-যুবকের দল। তাঁরা পূর্ব বাংলার খরস্রোতা নদীগুলো থেকে যথাসম্ভব সুবিধা নেওয়ার মতো সাঁতারের কৌশল জানতেন ও অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন।
অন্ধকারে তাঁদের ডজন ডজন মাইল সাঁতরাতে হতো। বাঁশ বা পেঁপে পাতার চোঙা দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে নিকষ অন্ধকার পানিতে মাইন বহন করে শত্রুপক্ষের কাছাকাছি রেখে সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই সাঁতরে নিরাপদ দূরত্বে ফিরে যেতে হতো—যা কিনা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেমস বন্ড ধরনের কমান্ডোদের জন্যও একটা কঠিন কাজ।
সাঁতারু মুক্তিবাহিনীতে ১৩০ জন ছিলেন চট্টগ্রামের, খুলনা-চালনা অঞ্চলের ছিলেন ১০০ জন, ৪০ জনকে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে এবং ৩০ জনকে চাঁদপুর, দাউদকান্দি থেকে। তাঁদের ছিল সেই সাহসিকতা আর প্রাণশক্তি, যার বলে এ রকম কষ্টকর, বিপজ্জনক ও দুঃসাহসী অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
সাধারণত এমন কাজ দেওয়া হয় উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপকে, যাদের বলা হয় মেরিন কমান্ডো, উন্নত নৌবাহিনীতে এদের বলে ‘সিলস’।
সাঁতারু মুক্তিবাহিনী ৪টি টাস্কফোর্সে বিভক্ত ছিল। এগুলো ছিল চট্টগ্রাম, চালনা/খুলনা, নারায়ণগঞ্জ এবং দাউদকান্দি/চাঁদপুরে। প্রতি সেক্টরে ছিল চারটি করে টাস্ক ইউনিট। প্রতি টাস্ক ইউনিটে ১০টি করে টাস্ক এলিমেন্ট। প্রতিটি টাস্ক এলিমেন্টে ছিলেন তিনজন করে সাঁতারু যোদ্ধা।
প্রত্যেক যোদ্ধার ছিল প্রথমে একটি, পরে দুটি করে লিমপেট মাইন, একটি গ্রেনেড, একটি ছোরা, সাঁতারের জন্য পায়ে বাঁধা এক জোড়া ফিন এবং কবজিতে বাঁধা একটি করে কম্পাস। প্রতিটি টাস্ক ইউনিটের ছিল একটি করে গুলিভরা রাইফেল।
এই সামান্য অস্ত্রসরঞ্জাম নিয়ে বাঙালি সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর যুবকেরা যে অবিশ্বাস্য কাজ করেছেন, শত্রুপক্ষের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করেছেন, তা পৃথিবীর গেরিলাযুদ্ধগুলোর ইতিহাসে বিরল।
সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য তাঁরা ’৭১-এর আগস্টের ১৫-১৬ তারিখ অন্ধকার রাতে একসঙ্গে একজোটে চট্টগ্রাম, চালনা, খুলনা এবং নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশালের নদীবন্দরগুলোতে আক্রমণ করেন।
পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ভাবত বলে একসঙ্গে এতগুলো পয়েন্টে এমন অতর্কিত হামলায় হকচকিয়ে গিয়েছিল।
মুক্তিবাহিনীর সাঁতারু দল ছিল একটি ছোট্ট গেরিলা বাহিনী, পূর্ব বাংলার নদ–নদী, খালে-বিলে তাঁরা মাছের মতোই স্বচ্ছন্দে চলতে পারতেন।
এই স্বল্পসংখ্যক তরুণ-যুবক তাঁদের অপরিসীম সাহসিকতা, মাতৃভূমির জন্য ভালোবাসা, কষ্টসহিষ্ণুতা আর দৃঢ়তার বলে চট্টগ্রাম, চালনা, মোংলা ও খুলনা—পূর্ব পাকিস্তানের এ প্রধান চারটি বন্দর অচল করে দিয়েছিলেন।
এতে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বন্দর বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো পূর্ব পাকিস্তানে তাদের জাহাজ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
সূত্র: ১৬ আগস্ট ২০২১ প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত।
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে